বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পদ্মা সেতুর দক্ষিণ প্রান্তেই হচ্ছে

পদ্মা সেতুর দক্ষিণ প্রান্তেই হচ্ছে বিশ্বের অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধার দৃষ্টিনন্দন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। বর্তমান উন্নত বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ১০টি বিমানবন্দরের চেয়েও তুলনামূলক অত্যাধুনিক একটি আকর্ষণীয় বিমানবন্দর হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এ জন্য প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। প্রায় আট হাজার একর জমির নিয়ে অত্যাধুনিক এ বিমানবন্দরটি নির্মাণ বর্তমান সরকারের একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবে ক্ষমতাসীন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিমানবন্দরটি নির্মাণের কাজ প্রাথমিক সকল কাজ সম্পন্ন করেছে। এ বিমান্দবন্দরটি চালু হলে দেশের অর্থনৈতিক ও আকাশপথে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এ বিমানবন্দরটি নির্মাণের জন্য প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে জাপানের নিপ্পন ইকো কোম্পানিকে। তাদের বিশেষজ্ঞ দল স্থান নির্ধারণসহ সমীক্ষার সকল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সমীক্ষা ও প্রতিবেদন তৈরির কাজও প্রায় শেষ হওয়ার পথে। সিভিল এভিয়েশন বলছে, বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর থেকে আকাশপথে প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় ৪০০ যাত্রীবাহী ফ্লাইট ও ২০০ কার্গোবাহী ফ্লাইট অপারেশন সম্ভব হবে। প্রতি বছর কমপক্ষে এক কোটি ২০ লাখ যাত্রীর চেক ইন ও চেক আউট। বিমানবন্দর থেকে বের হয়েই মাত্র আধা ঘণ্টায় কোনো ধরনের যানজট ছাড়াই জিরো পয়েন্টে পৌঁছার সুবিস্তৃত সড়ক স্থাপনসহ অবকাঠামোগত বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় রেখে বিশ্বমানের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিমানবন্দরের সমীক্ষার কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে বলে জানিয়েছে সিভিল এভিয়েশন। জাপানের শীর্ষস্থানীয় নির্মাণ সংস্থা নিপ্পনের দুই ডজন বিশেষজ্ঞ দিনরাত কাজ করছেন দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ মেগা প্রকল্পের। দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্বখ্যাত ইনসিওন বিমানবন্দরের আদলে তৈরি করা হবে এ বিমাবন্দরটি। এ ছাড়া সিঙ্গাপুরে চাঙ্গী এয়ারপোর্ট, দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, হিথরো এয়ারপোর্টে মতোই অত্যাধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা রেখেই ড্রয়িং-ডিজাইন তৈরি করা হচ্ছে। শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, উন্নত বিশ্বের আধুনিক মডেলে বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর নির্মাণে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শুধু সিভিল এভিয়েশন নয়, গোটা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প। কমপক্ষে দুটো পদ্মা সেতুর সমান ব্যয়ে নির্মিত হবে এ এয়ারপোর্ট। জমি চূড়ান্ত করার পরবর্তী তিন মাসের মধ্যেই ড্রয়িং-ডিজাইন তৈরি করা হবে। ২০১৯ সালের প্রথমই পুরোদমে নির্মাণ কাজ শুরুর কথা রয়েছে বলে জানিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ইনকিলাবকে বলেন, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ বর্তমান সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি। দেশবাসীকে দেয়া এ প্রতিশ্রুতি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আমরা অগ্রাধিকারভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা আশা করছি, ২০১৯ সালের শুরুতেই পুরোদমে কাজ শুরু করতে পারব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থান নির্ধারণে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রকল্পের বিস্তারিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা’ শীর্ষক প্রকল্পটি মাদারীপুরের শিবচরের চরজানাজাতে স্থাপনের সম্ভাবনা সর্বাধিক। বর্তমানে ওই স্থানে নানা সমীক্ষার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন জাপানি পরামর্শক বিশেষজ্ঞরা। আগামী বছরের শেষে এবং ২০১৯ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু কথা রয়েছে।
সিভিল অ্যাভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শল এম নাইম হাসান গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা সরকারে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য অগ্রধিকার ভিত্তিতে কাজ করছি। প্রকল্পটির জন্য ১২০ কোটি টাকায় বিশেষজ্ঞ পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে জাপানের নিপ্পন কোই কোম্পানি লিমিটেডকে। যুগের চাহিদা পূরণ এবং আকাশপথে বিশ্বের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো উন্নত করতে সরকার এ প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে।
এয়ার ভাইস মার্শাল এম নাইম হাসান বলেন, বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দরটি হবে বিশ্বের একটি অত্যাধুনিক অন্যতম মডেল। যা শুধু দক্ষিণ এশিয়াই নয়, বিশ্বের অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধার উন্নত বিমানবন্দরগুলোর আদলের একটি আকর্ষণীয় দৃষ্টিনন্দন বিমানবন্দর। যা বাংলাদেশের আকাশপথে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।
সিভিল এভিয়েশন জানায়, পদ্মার ওপারে বঙ্গবন্ধুর নামে দেশের বৃহত্তম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে খুব শীঘ্রই। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চারটি স্থানে প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাইয়ের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। পদ্মা সেতুর দক্ষিণ পাশে এ বিমানবন্দরটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত অনেকটা চ‚ড়ান্ত বলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজে নিয়োজিত জাপানি নির্মাণ সংস্থার সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিরাপত্তা দেবে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে জাপানের শীর্ষস্থানীয় নির্মাণ সংস্থা নিপ্পন কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পর সমীক্ষার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। ২০ সেপ্টেম্বর নিপ্পন ও জাইকার ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সিভিল অ্যাভিয়েশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিরাপত্তা ব্যবস্থার কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং ২১ সেপ্টেম্বর এ চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়।
সিভিল অ্যাভিয়েশনের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটির কার্যাদেশে বলা হয়েছে- ঢাকার সঙ্গে উত্তম যোগাযোগ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের বিষয়টি সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শনপূর্বক স্থান নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হয়। উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের লক্ষে মোট ৯টি স্থান সরেজমিন পরিদর্শন করে ঢাকা থেকে দূরত্ব, যোগাযোগ ব্যবস্থা, জমির পর্যাপ্ততা, আন্তর্জাতিক রুট, সড়ক, রেল ও নদীপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা, ভবিষ্যতে স¤প্রসারণের সম্ভাবনা, পুনর্বাসন, যাতায়াত খরচ ইত্যাদি বিবেচনা করে উপরোক্ত চারটি স্থান নির্বাচন করা হয়।
বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় জানায়, ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যতগুলো আন্তর্জাতিক বিমানের রুট রয়েছে, তার সবগুলো দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। দূরত্বের বিবেচনায়ও আন্তর্জাতিক বিমানসমূহের অবতরণের জন্যও পদ্মার দক্ষিণ প্রান্ত উপযুক্ত স্থান। এখানে বিমানবন্দর স্থাপিত হলে এর পাশে এক লাখ একর খাস জমিতে একটি স্যাটেলাইট সিটি নির্মাণ সম্ভব হবে এবং এর দক্ষিণ-পূর্ব পাশে নরিয়ায় একটি আন্তর্জাতিক নৌ-কন্টেইনার টার্মিনাল স্থাপন করার সুযোগ থাকবে। মূলত এসব সুবিধা বিবেচনায় রেখেই জাপানের নিপ্পন কোম্পানির পরামর্শক বিশেষজ্ঞ দল কাজ করছেন।
‘প্রকল্পটি বাস্তবায়নের নিমিত্ত বেসামরিক পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে ঢাকার সঙ্গে উত্তম যোগাযোগ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের বিষয়টি সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শনপূর্বক স্থান নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া, পরবর্তীতে পদ্মা সেতুর দক্ষিণ প্রান্তে স্থাপনের জন্য জাপানি বিশেষজ্ঞ দল মতামত দেয়। এর আগে উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের লক্ষে মোট ৯টি স্থান সরেজমিন পরিদর্শন করে ঢাকা থেকে দূরত্ব, যোগাযোগ ব্যবস্থা, জমির পর্যাপ্ততা, আন্তর্জাতিক রুট, সড়ক, রেল ও নদীপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা, ভবিষ্যতে স¤প্রসারণের সম্ভাবনা, পুনর্বাসন, যাতায়াত খরচ ইত্যাদি বিবেচনা করে উপরোক্ত চারটি স্থান নির্বাচন করা হয়।
সিভিল অ্যাভিয়েশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশল শহীদুল আফরোজ বলেছেন, নিপ্পনের বিশেষজ্ঞরা এখন অবিরাম কাজ করে চলেছেন। এমন একটি বিশাল কাজে সম্পৃক্ত হতে পেরে তারাও গর্বিত। দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এ প্রকল্পে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজকে তারাও চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। প্রকল্পটিকে দু’ভাগে ভাগ করে তারা এগুচ্ছেন।
তিনি বলেন, প্রথম দফায় উপযুক্ত জমি বাছাই, দ্বিতীয় দফা ড্রয়িং-ডিজাইন তৈরি, সম্ভাব্য ব্যয় ও সময় নির্ধারণ। তবে উপযুক্ত জমি খুঁজে বের করাই হচ্ছে এ প্রকল্পের সবচেয়ে কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং। জমি নির্ধারণ করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ প্রকল্পের সমীক্ষা প্রতিবেদনের কাজ দেয়া হয়েছে জাপানি নির্মাণ সংস্থা নিপ্পনকে। ১২০ কোটি টাকার এ সমীক্ষার কাজ চলছে।
সিভিল এভিয়েশন সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট আগামী এক শ’ বছরের পরিকল্পনা বিবেচনায় নেয়া হলেও সেটা হবে ধাপে ধাপে। প্রথম ধাপে আগামী ৩০ বছরে দেশের এভিয়েশন সেক্টর কতটা বৃদ্ধি পাবে, কত উড়োজাহাজ ওঠানামা করার প্রয়োজনীয়তা থাকবে সেটা বিবেচনায় রেখে এয়ারপোর্টের নকশা তৈরি করা হচ্ছে।
জানা যায়, ১২০ কোটি টাকার সমীক্ষায় কাজ করছেন নিপ্পনের দু’ডজন বিশেষজ্ঞ। এদের মধ্যে রয়েছে অর্থনীতিবিদ, ভ‚তত্ত¡¡বিদ, নদী গবেষক, এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট, রাডার আইকাও মনোনীত এভিয়েশন, রানওয়ে ও স্থাপত্যবিদসহ ১৭ ক্যাটাগরির বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে তারা একযোগে নিজ নিজ এসাইনমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত।