তথ্য যোগাযোগ প্রযুুক্তির বিকাশ : শিক্ষাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন

তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, এর নেতিবাচক দিকও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির সংযোগ একদিকে যেমন শিক্ষার অগ্রগতিকে বেগবান করছে, অন্যদিকে মানবিক, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন থেকে মানুষ দূরে সরে যাচ্ছে। এ বিপরীতমুখিতাকে কীভাবে পরিহার করা যায়, সেটা নিয়েও ভাবা দরকার

আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে পৃথিবীতে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। শিল্পবিপ্লব পৃথিবীকে এমনভাবে আলোড়িত করেছিল যে, পৃথিবী নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছিল। এ বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আরেকটি ধারা এসেছে একবিংশ শতকে, বর্তমান পৃথিবীতে। আর এ বিপ্লব এনেছে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি বা ওঈঞ। তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির এ বিকাশ সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে শিক্ষাক্ষেত্রকে। শিক্ষা গ্রহণে এখন তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি অনেকটা অপরিহার্য ক্ষেত্র বিশেষে বাধ্যতামূলক। এখন তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি শিক্ষা শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তিকে এমনভাবে সন্নিবেশ করা হয়েছে যে, ইচ্ছা করলেই কেউ এখন আর তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি ছাড়া শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে না। শিক্ষানীতি ২০১০-এ তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি শিক্ষার দুইটি উদ্দেশ্য হলো :
তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে দক্ষ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, শিক্ষিত আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরি করা। এ খাত শুধু কম্পিউটার বিজ্ঞানে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং মোবাইল ফোন, রেডিও, টেলিভিশন, তথ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণও তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির আওতাভুক্ত থাকবে। তথ্যপ্রযুক্তি খাত সম্প্রসারণে কিছু কৌশলও নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ভোকেশনাল ও টেকনিক্যাল শিক্ষায় :
প্রাথমিক স্তর থেকে পরবর্তী সব পর্যায়ের শিক্ষাস্তরে কম্পিউটারকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হবে। মাধ্যমিক পর্যায়ে যাওয়ার আগেই সব শিক্ষার্থী কম্পিউটারে সাক্ষরতা লাভ করবে। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ের সঙ্গে কম্পিউটার বিষয়ও অধ্যয়ন করবে।
ভোকেশনাল ও টেকনিক্যাল বিষয়ের শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নে অবশ্যই গ্রাফিক ডিজাইন, মাল্টিমিডিয়া, অ্যানিমেশন, ঈঅউ/ঈঝগ ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তিকে উৎসাহিত করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আইটি অলিম্পিয়াড আয়োজন করা।
উচ্চ শিক্ষাস্তরে :
দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষাক্রমের আলোকে কম্পিউটার সায়েন্স এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ খোলা। কম্পিউটার সায়েন্স এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাক্রম নিয়মিত আপডেট করা হবে। এছাড়া দক্ষ আইটি মানবসম্পদ গড়ার লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অফার দেয়া হবে।
শিক্ষার্থীরা যেন দক্ষ আইটি মানবসম্পদে পরিণত হতে পারে তার সুযোগ সৃষ্টি করা। প্রয়োজনে তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গভীর সম্পর্ক তৈরি করা হবে।
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে আইটি সুবিধা বৃদ্ধি করে সত্যিকারের ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা।
এমন একটি পদ্ধতি তৈরি করা হবে, যাতে দেশের সব গ্র্যাজুয়েট ২০১৩ সালের মধ্যে কম্পিউটারের মৌলিক দক্ষতা অর্জন করে। শিক্ষকদের আইটি প্রশিক্ষণে দেশে একটি তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে গবেষণার সুবিধা সৃষ্টি করা।
শিক্ষানীতিতে বর্ণিত তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি বিকাশের এ আশাব্যঞ্জক প্রতিশ্রুতি একবিংশ শতাব্দীর সত্যিকার আবেদনের বহিঃপ্রকাশ বলা যায়। শিক্ষানীতির আলোকে দেশে তথ্যপ্রযুক্তির অনেক উন্নতিও হয়েছে; কিন্তু সেটা কি যথেষ্ট?
মানুষের আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তনই হলো শিক্ষা। শিক্ষার তিনটি ডোমেন আছে। এগুলো হলোÑ জ্ঞান, দক্ষতা ও আচরণ। এর একটিরও যদি ঘাটতি হয় তবে সেটা প্রকৃত শিক্ষা হবে না। যেমন তথ্যপ্রযুক্তি খাতে জ্ঞান আছে, প্রয়োজনীয় দক্ষতাও আছে; কিন্তু আচরণ ইতিবাচক নয়, তাহলে সেটাকে আমরা শিক্ষা বলতে পারি না। মানুষ নানাভাবে জ্ঞান অর্জন করে। তারপর সেই জ্ঞান প্রয়োগ করে দক্ষতা অর্জন করে। আর এ সার্বিক অর্জনের মধ্য দিয়ে তার আচরণিক পরিবর্তন সাধিত হয়। তবে এ আচরণিক পরিবর্তনই শিক্ষার মূল। কারণ আচরণ ইতিবাচক হতে পারে আবার নেতিবাচকও হতে পারে। আচরণের যদি ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে তবে শিক্ষা সার্থক হয়েছে বলা যায়। তবে আচরণের নেতিবাচক পরিবর্তন সমাজে বিরূপ প্রভাব ফেলে। তথ্যপ্রযুক্তি এখন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, সামাজিক যোগাযোগ, বিনোদন প্রতিটি ক্ষেত্রকেই প্রভাবিত করছে।
বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকা, কাজ করা, শিক্ষা অর্জন কিংবা সামাজিক হওয়ার জন্য তথ্যপ্রযুক্তি ব্যাপক প্রাধান্য বিস্তার করেছে। এখন মানুষ ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ইত্যাদি ছাড়া চলতে পারে না। তথ্যপ্রযুক্তির এ রূপান্তর ও বিস্তার এতই দ্রুতগতিতে ঘটেছে যে, মানুষ তার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারেনি। এজন্যই শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক সংযোগ।
বাংলাদেশ সরকার তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের ওঈঞ পলিসি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠনে ওঈঞ অবকাঠামো উন্নয়ন এবং শিক্ষায় ওঈঞ ব্যবহারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। শিক্ষায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের মহাপরিকল্পনা (২০১২-২০২১)-এ ২০১৮ সালের মধ্যে শিক্ষায় ওঈঞ ব্যবহারের জন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ওঈঞ ল্যাব স্থাপনসহ প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি ক্লাসরুমকে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে রূপান্তর করার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষায় ওঈঞ ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে এরই মধ্যে সারা দেশে প্রায় ৩৫ হাজারেরও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করেছে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে।
তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, এর নেতিবাচক দিকও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির সংযোগ একদিকে যেমন শিক্ষার অগ্রগতিকে বেগবান করছে, অন্যদিকে মানবিক, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন থেকে মানুষ দূরে সরে যাচ্ছে। এ বিপরীতমুখিতাকে কীভাবে পরিহার করা যায়, সেটা নিয়েও ভাবা দরকার। তা না হলে তথ্যপ্রযুক্তির আড়ালে মানবিক, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক একদিন হয়তো হারিয়ে যাবে। সুতরাং সতর্কতার সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।