দেশের তৃণমূল পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। সে লক্ষ্যে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার। ফলে ঢাকায় দীর্ঘদিন অবস্থানরত চিকিৎসকদের তৃণমূল পর্যায়ে পাঠানো হবে। কারণ স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ৩ বছরের অধিক সময় ঢাকা অবস্থানকারী চিকিৎসকরা আর ঢাকায় অবস্থান করতে পারবেন না। আর তা নিশ্চিত করতে ঢাকায় অবস্থানরত চিকিৎসকদের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। যে কোনো সময় তাদের ঢাকার বাইরে বদলির আদেশ জারি করা হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, অতীতে সরকার সমর্থক চিকিৎসক সংগঠনের সদস্যরা ক্ষমতার জুড়ে ঢাকাতেই অবস্থান করে আসছে। কোনোভাবেই তাদের ঢাকার বাইরে পাঠানো যেত না। কিন্তু এবার আর তা হচ্ছে না। কারণ বর্তমান সরকারের সমর্থক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপের) নেতা হলেও এক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া হবে না। সরকারের এমন অবস্থানে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। কারণ রাজধানীর অধিকাংশ হাসপাতালেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ৫ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত অনেক চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৪ বছর ধরে রয়েছেন একজন সহযোগী অধ্যাপক। এমন আরো অনেক চিকিৎসকই দীর্ঘদিন ঢাকাতেই কর্মরত আছেন। সূত্র জানায়, ঢাকার বাইরে তৃণমূলে চিকিৎসক সঙ্কট থাকলেও ঢাকার অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানেই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি চিকিৎসক রয়েছেন। আর ঢাকার বাইরে চিকিৎসকের পদ শূন্য থাকলেও কেউই ঢাকার বাইরে গিয়ে থাকতে চান না। অভিযোগ রয়েছে, দলবাজির কারণেই চিকিৎসকরা গ্রামে থাকতে চান না। সরকারি কর্মকর্তাদের অদক্ষতা এই পরিস্থিতির জন্য দায়ি। প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসকদের গ্রামের কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে একাধিকবার অনুরোধ ও নির্দেশ দিয়েছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীও চিকিৎসকদের গ্রামে ৩ বছর থাকার কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ চিকিৎসকই তা অনুসরণ করছে না। ফলে গ্রামে চিকিৎসক না থাকাসহ চিকিৎসকদের আচরণ নিয়ে জাতীয় সংসদে ইতিপূর্বে সংসদ সদস্যরা কয়েক দফা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চাচ্ছে যেসব চিকিৎসক একটানা ৩ বছর গ্রামে থেকেছেন, তাদের ঢাকায় আসার সুযোগ করে দেয়া। আর যারা ঢাকায় ৩ বছরের অধিক সময় অবস্থান করছেন, তাদের গ্রামে গিয়ে চিকিৎসা সেবা দেয়া। কারণ চিকিৎসকদের নিয়োগ বদলি নীতিমালায়ও তা উল্লেখ রয়েছে। এবার অক্ষরে অক্ষরে তা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে সরকার।
সূত্র আরো জানায়, এমবিবিএস শেষ করার পর প্রায় সব চিকিৎসকই ঢাকায় থাকতে আগ্রহী। কারণ ঢাকায় ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখার এবং বেসরকারি ক্লিনিকে কাজ করার সুযোগ বেশি। ফলে ঢাকা কিংবা আশপাশে পদায়ন চান সবাই। অনেকে আবার নানা অজুহাত দেখিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। স্নাতকোত্তর শিক্ষার নামে চিকিৎসকদের ঢাকায় আসা এক রকম নিয়মে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে এমডি, এমএস, এফসিপিএস, এমফিল ও ডিপ্লোমা কোর্সে এক হাজার ৪৯৭ জন চিকিৎসক প্রেষণে আছেন। ঢাকা না ছাড়তে অনেকে একটি কোর্স শেষ করে অন্য কোর্সে ভর্তি হন। তাছাড়া সংযুক্তির (অ্যাটাচমেন্ট) মাধ্যমে অনেকে রাজধানীর বড় বড় হাসপাতালে কাজ করছেন। রাজধানীর অধিকাংশ হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে অনুমোদিত পদের চেয়ে বেশিসংখ্যক চিকিৎসক কাজ করছেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, পঙ্গু হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে দু’একজন নয়, অনেক চিকিৎসকই ৫ থেকে ১০ বছর ধরে আছেন। কেউ কেউ আবার ১৩/১৫ বছর ধরে অবস্থান করছেন। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি করে তারা ঢাকায় থাকছেন। আবার কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলেরই নেতা বনে যাচ্ছে। বিএনপির সময় বিএনপি, আর অওয়ামী লীগের সময় আওয়ামী লীগ। মূলত বিএমএ ও স্বাচিপের এক শ্রেণীর নেতা এবং মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সমন্বিত সিন্ডিকেটের কারণে কোনোভাবেই ওসব চিকিৎসকদের ঢাকার বাইরে বদলি করা যায় না। ঢাকার বাইরে বদলি করা না গেলেও ওসব চিকিৎসকের অধিকাংশই বৃহস্পতি থেকে শনিবার ঢাকার বাইরে প্রাইভেট প্রাকটিস করতে যান। প্রাইভেট প্রাকটিসের জন্য গ্রামে যেতে পারলেও সরকারি চাকরি করতে যেতে আগ্রহী নন তারা।
এদিকে জেলা ও উপজেলাসহ ইউনিয়ন পর্যায়ের বেশিরভাগ বেসরকারি ক্লিনিকে ঢাকার চিকিৎসকরা প্রাইভেট প্রাকটিস করেন। অনেকের সাইনবোর্ড আছে, অনেক এলাকায় আবার মাইকিং করে বলা হয়, ঢাকা থেকে ওমুক ডাক্তার আসছেন। এই ৩ দিন রাজধানীর সরকারি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেবা ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না তারা। কারণ ওসব চিকিৎসকের হাত অনেক লম্বা। তাছাড়া যেসব চিকিৎসক ঢাকায় দীর্ঘদিন ধরে আছেন তাদের অনেকের যোগ্যতাও কম। কারণ চিকিৎসা সেবার চেয়ে রাজনীতিকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসকরা যত বেশি চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত থাকবেন, ততবেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জানান, সরকার একসঙ্গে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার চিকিতৎসক নিয়োগ দিয়ে তাদের গ্রামে পদায়ন করেছিল। ৩ বছর তাদের সেখানে থাকার নির্দেশনা ছিল। ৩ বছর পর তাদের ভাল জায়গায় আসার সুযোগ দেয়া হবেও বলা হয়েছিল। একই সাথে ৩ বছরের বেশি সময় কোনো চিকিৎসকও ঢাকায় থাকতে পারবেন না। সরকার এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিচ্ছে। যে কোনো মূল্যে সরকারের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে।