সুঁই-সুতায় স্বপ্নগাথা

সূচের ফোঁড়ে ভাগ্য বদল। অভাবনীয় বিপ্লব ঘটছে সুচী শিল্পের। সুচ-সুতার আলপনায় তৈরী হচ্ছে চোখ জুড়ানো নকশীকাঁথা ও শাড়ী। নকশীকাঁথা শিল্পে যশোর রয়েছে শীর্ষে। শিল্পটি ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে। কেউ স্বীকৃতি দিক বা না দিক দীর্ঘদিন ধরে নীরবেই সামনে দিকে যাচ্ছে শিল্পটি। পিছিয়ে পড়ার কোন আশঙ্কা নেই।
সরকারী পৃষ্টপোষকতা পেলে আরো দ্রæতগতিতে শিল্পটির প্রসার ঘটতো। দৃষ্টির আড়ালে থাকা বিরাট সম্ভাবনাময় হস্তশিল্প গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে নিজ নিজ উদ্যোগে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এখন শুধু দেশের ভেতরে নয় দেশের বাইরেও এর বাজার সৃষ্টি হয়েছে। মহিলাদের সূচের ফোঁড়ে ফোঁড়ে বিদেশ থেকে আসছে টাকা। আন্তরিকতা ও নিষ্ঠায় ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটছে দুঃস্থ, অসহায় ও অভাবী মহিলাদের। শুধু নকশীকাঁথা ও শাড়ী নয়, ভিন্ন সৌন্দর্যের রং বে রং এর আকর্ষনীয় ডিজাইনের বেড কভার, হাত ব্যাগ, কুশন কভার, ওয়াল ম্যাট ও টেবিল ক্লথসহ সূচ-সুতা দিয়ে তৈরী বিভিন্ন জিনিস।
দেশের বাজার ছাড়াও বিদেশে চাহিদা বাড়ছে। জাপান, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন ও মালয়েশিয়ায় রফতানী হচ্ছে। সুচী শিল্পের নিপুনতায় যশোরে তৈরী হচ্ছে বিদেশীদের চাহিদাফর্দ অনুযায়ী পণ্য। যার নামকরণ হচ্ছে ‘যশোর স্টিচ’। দেশের বাইরে এখন যশোরের নকশীকাঁথা ও নকশী শাড়ীর নাম ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপকভাবে। যশোরের অন্তত ১৫টি গ্রামের প্রায় ১০ হাজার মহিলা সুচী শিল্পে জড়িত রয়েছেন। তারা সংসারের কাজকর্ম শেষে অবসর সময়ে বাড়ীতে বসেই কাঁথা ও শাড়ীতে নকশা করছেন। গ্রামবাংলায় কাঁথা সেলাই এর ঐতিহ্য বহুকাল আগের। পুরানো শাড়ী ও লুঙ্গি মাটিতে বিছিয়ে চারিদিকে খেজুরের কাঁটা দিয়ে মহিলারা নিজেদের প্রয়োজনে কাঁথা সেলাই করে থাকে। নতুন কাঁথা বিছিয়ে অতিথিকে বসতে দেয়ার রেওয়াজ গ্রামে গ্রামে রয়েছে এখনো। মূলত গ্রামের মহিলারা সুচী শিল্পের জন্ম দেয়। কাঁথা তৈরী ও বিক্রির ইতিহাসও অনেক পুরানো। তারই ধারাবাহিকতায় যশোরে নকশী কাঁথা ও সূচী শিল্প গড়ে উঠেছে। শিল্পটির সাথে জড়িতরা এখন আর সংসারের বোঝা নয়। উল্টো সংসারে অর্থ যোগান দিচ্ছে। দিন কাটাচ্ছেন বেশ সাচ্ছন্দ্যে। নির্দিষ্ট এক ছকে তারা ঘুরপাক খাচ্ছিলেন। এখন দিগন্ত প্রসারিত হয়েছে। একটি গোষ্ঠী জীবনে ভিন্ন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। যশোরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সুচী শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের পৃষ্টপোষকতা করছে। যশোরের বাজারে বেশ কয়েকটি অভিজাত বিপণীতে নকশী কাঁথা বা নকশী শাড়ী পাওয়া যায়। স্থানীয় চাহিদা মিটানোর পর কাঁথা ও শাড়ী যায় রাজধানী ঢাকায়। সেখান থেকে চাহিদামতো যায় বিভিন্ন দেশে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দিনে দিনে বিদেশের বাজারে যশোরের নকশীকাঁথার ব্যাপক চাহিদা বাড়ছে।
সরেজমিনে যশোরের নোঙ্গরপুর, পান্তাপাড়া, সীতারামপুর, ফতেপুর, কনেজপুর ও বালিয়াডাঙ্গাসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেল চমৎকার দৃশ্য। গুনগুনিয়ে গান গেয়ে দলবদ্ধভাবে মহিলারা সুচ-সুতার কাজ করছেন। তাদের সূচ ও সুতার সরবরাহ করছে বিভিন্ন উৎপাদনকারী ও ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে প্রায় ১০ মহিলা কাজ করছেন। বিদেশে রফতানীযোগ্য সূচী শিল্প পণ্যও তৈরী করছেন। সুূচী শিল্পের সাথে জড়িত মহিলারা দারুণ ব্যতিব্যস্ত। সংসারের কাজের ফাঁকে তারা বসে বসে সুচ-সুতা দিয়ে বিভিন্ন আকর্ষণীয় পণ্য তৈরী করছেন মহিলারা। দিনে দিনে বিদেশীদের কাছে বাংলার সুচী শিল্প পণ্যের কদর বেড়েছে বহুগুণে। খোলাডাঙ্গা গ্রামের সূচী শিল্পী সুফিয়া বেগমের সাথে কথা হয়। তার স্বামী মারা যান কয়েক বছর আগে। ৫ সন্তানের বোঝা পড়ে সুফিয়া বেগমের উপর। তার স্বামী ছিলেন দিনমজুর। সংসার চলতো কোনরকমে। স্বামীর মৃত্যুর পর আকাশ ভেঙে পড়ে সুফিয়ার মাথায়। কি খাবে, ছেলেপেলেদের কি খাওয়াবে সেই দুশ্চিন্তায় কাহিল হয়ে পড়েন সুফিয়া বেগম। সংসার এলোমেলো হয়ে যায়। একপর্যায়ে তিনি সুচী শিল্পের সাথে জড়িত হন। তিনি এখন স্বাবলম্বী। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখাচ্ছেন। এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। সুফিয়ার মতো অসংখ্য দুঃস্থ, অভাবী ও অসহায় মহিলা সুচী শিল্পের সাথে জড়িত হয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন।