চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য তৈরিতে কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে টানাটানি থাকলেও এর উচ্ছিষ্টের কদরও কম নয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবির দেওয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) প্রাণীর ফেলে দেওয়া পেট, গোল্লা, হাড় ও শিং রপ্তানি করে আয় হয়েছে এক কোটি ৬৫ লাখ ডলার বা (এক ডলার ৮১ টাকা হিসাবে) ১৩৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা পেলে এ আয় দ্বিগুণ করা সম্ভব।
ইপিবির দেওয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এসব পশুর বর্জ্যের বড় বাজার হলো ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, হংকং, চীন ও জাপান। গত তিন অর্থবছরে পশুর বর্জ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এক কোটি ৬৫ লাখ ডলার, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আয় হয়েছে এক কোটি ৬১ লাখ ডলার এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দুই কোটি ডলার।
এদিকে সরকারের লক্ষ্য দেশের সুবর্ণ জয়ন্তীতে ২০২১ সালে পণ্য রপ্তানি আয় ৬০ বিলিয়ন ডলার বা ছয় হাজার কোটি ডলার করা। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে আয়ের লক্ষ্য ৫০০ কোটি ডলার। আর শুধু তৈরি পোশাক খাত থেকে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি ডলার। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, কোরবানির পশুর বর্জ্য যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে পশুর এসব উচ্ছিষ্টও সরকারের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। এ জন্য সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর মতো পরিকল্পিত জায়গায় পশুর বিভিন্ন অঙ্গ দিয়ে পণ্য তৈরি করে তা রপ্তানি করা যেতে পারে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূলত পাকিস্তান আমল থেকে এ দেশে এই ব্যবসার শুরু হয়েছে।
কিন্তু স্বাধীনতাপরবর্তী কোনো সরকার উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। যেটুকু কাজ হয় তা চামড়াকে ঘিরেই। তাই আড়ালে পড়ে থাকা এ ব্যবসার আকার এ দেশে খুব বেশি বাড়েনি। সংগত কারণেই হাড় ব্যবহার করে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে উদ্যোক্তার প্রচুর অভাব রয়েছে এ দেশে। একই সঙ্গে সরকারি সহযোগিতারও অভাব রয়েছে। এসব কারণে দেশীয় পশুর হাড় থেকে তৈরি পণ্যের যথেষ্ট চাহিদা থাকার পরও সুযোগটি কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
তাঁরা জানান, এখানে হাড় ও শিং থেকে সামান্য পরিমাণে চিরুনি, বোতাম, হস্তশিল্প তৈরি করা হলেও চাহিদার অধিকাংশই আমদানি করা হয় বিদেশ থেকে। অথচ দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠা করা গেলেই আমাদনি বন্ধের পাশাপাশি রপ্তানির জন্য পড়ে রয়েছে বিশাল বাজার। বাংলাদেশে গরু, মহিষ, ছাগলের সব রকমের হাড়, পায়ের খুর, দাঁত, শিং সবটুকু অংশই ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ক্যাটাগরির হাড়ের মধ্যে দেশে ক্যাশবোন নামের ভালোমানের একটি হাড় প্রক্রিয়াজাত করা হয়, যার প্রধান ক্রেতা ওষুধ কম্পানিগুলো। এ দিয়ে তৈরি হয় উন্নতমানের ক্যাপসুল (ওষুধের নমনীয় মোড়ক)।
বাংলাদেশ বোন এক্সপোর্টার্স অ্যান্ড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, হাড় থেকে তৈরি হয় বোতাম। কিন্তু ভালোমানের বোতাম তৈরির কোনো কারখানা দেশে নেই। চাহিদার সবটুকুই মেটানো হয় আমাদানি থেকে। অথচ বোতাম তৈরির কাঁচামাল বিদেশে রপ্তানি করা হয়। ইউরোপে আবার প্রচুর চাহিদা রয়েছে ভালোমানের বোতামের। সংগঠনের আহ্বায়ক কমিটির প্রধান মো. জাকির হোসেন বলেন, দেশে-বিদেশে হাড়-খুর-শিং এবং এগুলো থেকে উৎপাদিত পণ্যের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। ভালোমানের কারখানা গড়ে উঠলে দেশ ও বিদেশের বাজার—দুটোতেই বড় ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রবিউল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, সারা দেশে পাঁচ-ছয় হাজার এজেন্টের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয় এসব হাড়-শিং। টোকাইদের মাধ্যমে এজেন্টরা এসব সংগ্রহ করে। এজেন্টদের কাছ থেকে কারখানাগুলো সাধারণত প্রতি কেজি ১৮-২০ টাকা দরে এসব কেনে। কিন্তু কোরবানি এলে এ দাম অর্ধেকে নেমে আসে। প্রচুর পরিমাণ অপরিষ্কার হাড় এ সময় কেনা হয় ১০-১২ টাকা কেজি দরে।
রবিউল আলম আরো জানান, প্রতি টন হাড় রপ্তানি করা হয় ৩৫-৪০ হাজার টাকায়। প্রক্রিয়াজাত করে ভালোমানের হাড় বাছাই করে রপ্তানি করা গেলে তা ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায় বলে জানান তিনি। কী পরিমাণ বর্জ্য এবার কোরবানির পশু থেকে সংগ্রহ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সংগ্রহে রয়েছে এক হাজার মণ হাড়, পুরো ঢাকায় আরো ছয় হাজার মণ হাড় সংগ্রহের আশা করছেন তাঁরা। এ ছাড়া রাজধানী থেকে ১২ হাজার কেজি যৌনাঙ্গ এবং পাঁচ হাজার মণ পশুর গোল্লা সংগ্রহের আশা করছেন তাঁরা।
জানতে চাইলে হাড় সংগ্রহকারী হান্নান মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজধানীতে ঈদের সময় পশু কোরবানির পর হাড় সংগ্রহ করে টোকাইরা। তারা হাড় ভাঙারির দোকানে বিক্রি করে। পরে সেই উচ্ছিষ্ট যায় হাজারীবাগের হাড্ডিপট্টির আড়তে। তিনি আরো বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গরু ও মহিষের যৌনাঙ্গ সংগ্রহ করা হয়। এর প্রতিটির রপ্তানি মূল্য পাঁচ থেকে ছয় ডলার।