বোরো উত্পাদন মার খাওয়ার কারণে দেখা দেওয়া চাল সংকট মেটাতে এখন আমনই ভরসা। আর ৩৯ দিনের মধ্যেই কৃষকের ঘরে উঠতে শুরু করবে নতুন ধান।
এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬০ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে চাষ করা হয়েছে আমন। তার ওপর বন্যার পলিতে বেশ ভালো ফলন হয়েছে। কৃষকের পাশাপাশি সাধারণ ভোক্তাদের চোখেও স্বপ্ন এ আবাদ ঘিরে। প্রকৃতি সদয় হলে এই আমন দিয়েই চরম অস্বস্তি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা করছে সরকারও।
টার্গেট ছিল ৫৩ লাখ পাঁচ হাজার হেক্টরের, কিন্তু রোপা আমনের চাষ হয়েছে আরো ৬০ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে। এর থেকে এক লাখ ৩৭ হাজার টন ধান উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. গোলাম মারুফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর কৃষকরা বেশি করে আমন লাগিয়েছে। অনেকে পাট কেটে সবজি চাষের জন্য জমি ফেলে না রেখে আমন বুনেছে। সব কিছু মিলিয়ে ফলন নিয়ে আমরা দারুণ আশাবাদী।
কারণ বন্যার পর পলিতে ভালো ফলন হয়। শুধু আমনই নয়, অন্যান্য ফসলও কয়েক বছর ভালো হয়। ’
তিনি আরো বলেন, ‘আশার কথা হচ্ছে, আমন কাটা শুরু হতে আর মাত্র ৩৯ দিন বাকি আছে। কার্তিকের ২০ তারিখ থেকে পুরোদমে ধান তোলা শুরু হবে। তবে এরই মধ্যে কিছু কিছু জায়গায় আমন কাটা শুরু হয়েছে। এই ধান অনেক আগে লাগানো। নীলফামারী, রংপুর ও হাওরের কিছু জায়গায় এ বিশেষ আমন লাগানো হয়। নতুন ধান উঠতে শুরু করলে চালের দাম কমে যাবে। ’
দিনাজপুরে বেশ ভালো ধান হয়। সেখান থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানান, এবার দিনাজপুরে দুই লাখ ৫৩ হাজার ৬৮৭ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। কিন্তু আগস্ট মাসের শুরুতে শুরু হয় ভয়াবহ বন্যা। ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয় কৃষকরা। এক লাখ ২১ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়। আশঙ্কা দেখা দেয় আমন চাষে বিপর্যয় ঘটার। কৃষি বিভাগ ত্বরিত পদক্ষেপ নিয়ে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালায়। এতে সফলতাও আসে। নাবি জাতের ধানের বীজতলা তৈরি করে ও দগচি দিয়ে শুরু হয় ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে আমন চারা রোপণ। শেষ পর্যন্ত আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় দুই লাখ ৫৬ হাজার ৭১০ হেক্টরে।
আমন উত্পাদন বাড়াতে সরকার নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। কলার ভেলায় আপত্কালের জন্য রোপা আমনের ভাসমান বীজতলা তৈরি করেছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বীজতলা তৈরির জন্য সাত লাখ ৫৮ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আপত্কালীন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে নাবি জাতের রোপা আমন ধানের বীজ বিতরণের জন্য তিন লাখ দুই হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। বীজতলা তৈরি, চারা উত্তোলন ও বিতরণের জন্য ৯০ লাখ ৮৬ হাজার টাকা সাত হাজার ৭৮০ জন কৃষকের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। বন্যার আগাম সতর্কতা পেয়ে গত ২৭ জুলাই সংসদীয় কমিটির বৈঠকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্তদের প্রণোদনা বা পুনর্বাসনের পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। পরে সে অনুযায়ী কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়া হয়।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘যে বছর বন্যা হয়, সেই বছর ফলনও ভালো হয়। বন্যার পলি ধানের জন্য খুবই উপকারী। তা ছাড়া আমরা বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। আর কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আমনের বাম্পার ফলন হবে। ’
কয়েক বছর ধরেই ধান চাষে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। লাভ না হওয়ায় কৃষকরা ধান ছেড়ে সবজি চাষের দিকে ঝুঁকছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অন্যতম সবজি উত্পাদনকারী দেশ। তবে কৃষকরা এভাবে ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেললে বাংলাদেশ ভয়ংকর বিপদে পড়বে বলে জানিয়েছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমদানি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত এ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, বিদেশ থেকে চাল কিনে এনে বিপুলসংখ্যক মানুষকে খাওয়ানো সম্ভব নয়। তাই ধান চাষে যেকোনো মূল্যে কৃষকদের ধরে রাখতে হবে। প্রয়োজনে প্রণোদনা বাড়াতে হবে।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে আউশের উত্পাদন ছিল ২১ লাখ ৩৪ হাজার টন, যা আগের বছরের তুলনায় ৬.৮ শতাংশ কম। আবাদের জমি কমায় এ বিপত্তি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চলতি বছর ১১ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর লক্ষ্যমাত্রা ধরলেও শেষ পর্যন্ত ১০ লাখ ৯২ হাজার হেক্টরে আউশ আবাদ হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ শতাংশ কম।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। উত্পাদনের টার্গেট ছিল এক কোটি ৯১ লাখ টন। শেষ পর্যন্ত ৪৭ লাখ ৯৭ হাজার হেক্টরে আবাদ হলেও বোরো কাটার ঠিক পূর্বমুহূর্তে ভারি বৃষ্টি হয়। এতে করে হাওর এলাকার ধান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট সরকারকে জানিয়েছে, বন্যা ও ব্লাস্ট রোগের কারণে বোরোর ফলন ৫ শতাংশ কম হয়েছে।
সাবেক কৃষিসচিব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এবারের আমন আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বলে শেষ করা যাবে না। তবে এর ওপর ভরসা করে বসে থাকলে চলবে না। কারণ আমাদের দেশে কৃষকরা সাধারণত আমন ধান বিক্রি করে না। এটা তারা নিজেদের খাবার হিসেবে ব্যবহার করে। সর্বোচ্চ দুই-তিন লাখ টন চাল হয়তো আমন মৌসুমে সংগ্রহ করতে পারবে খাদ্য অধিদপ্তর। কাজেই আমন ভালো হলেও সরকারকে আমদানির ওপরই নির্ভর করতে হবে। এই নির্ভরতা আগামী বোরো মৌসুম পর্যন্ত চলতে থাকবে। ’
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, টানা এক বছর আমদানি করে সরকারের সরবরাহ লাইন ঠিক রাখা কঠিন। কিন্তু এ ছাড়া কোনো বিকল্পও নেই। আমন উঠবে কিন্তু সরকার খুব বেশি সংগ্রহ করতে পারবে না। এমনকি বাম্পার ফলন হলেও না। তাই আমন ভালো হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চাল সংগ্রহ করা খুবই জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ। চলতি বছর ভারতের কাছে প্রথম জিটুজি পদ্ধতিতে চাল চাওয়া হয়েছিল। তারা এমন দাম চাইল, যা বাজারদর থেকে অনেক বেশি। বাংলাদেশের সঙ্গে জিটুজি করার ভারতীয় প্রতিষ্ঠান পিইসির প্রতিনিধিরা প্রতি টন চালের জন্য ৫১৬ ডলার চেয়েছিলেন। অথচ তখন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন চালের দাম ছিল ৪৪০ ডলার। এত বেশি দামে চাল কেনা হলে ভবিষ্যতে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। এ কারণে জিটুজি প্রক্রিয়ায় ভারত থেকে চাল আমদানি করা সম্ভব হয়নি।
থাইল্যান্ড থেকেও চাল আনার চেষ্টা করা হয়েছে। দেশটির ডিপার্টমেন্ট অব ফরেন ট্রেড বা ডিএফটির প্রতিনিধিরা ঢাকায় এসেছিলেন। বাজারদর ৪৪০ ডলার থাকলেও ডিএফটি ৫০৮ ডলারের কমে চাল দিতে রাজি হয়নি। ভারত, থাইল্যান্ডে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশ যায় ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারে। ভিয়েতনাম থেকে আড়াই লাখ টন চাল আনার চুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে দেড় লাখ টন চলে এসেছে। অবশিষ্ট চালও বাংলাদেশের বন্দরে পৌঁছেছে। কম্বোডিয়া থেকেও আড়াই লাখ টন চাল আমদানি করার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার থেকে এক লাখ টন চাল আনার ঘোষণা দেওয়া হলেও তারা কোনো চুক্তি করেনি।
দাম কমানোর জন্য সরকার খোলা বাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) শুরু করেছে। কিন্তু সেই চাল আতপ হওয়ায় ক্রেতাদের সাড়া কম। এ সময় সিদ্ধ চাল খোলা বাজারে বিক্রি করলে দাম আরো কমত বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।