চার বছর আগে সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের পোশাক ছিল একটি ঝুঁকিপূর্ণ খাত। বিশাল রপ্তানি আয়ের এ খাতটি গড়ে উঠেছিল একেবারে অপরিকল্পিতভাবে। একই ভবনে ব্যাংক, বাজার এবং পোশাক কারখানা। ফলে দুর্ঘটনার সময় নিরাপদে বের হওয়ার জরুরি কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তবে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর একটি বিপজ্জনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ খাত থেকে বের হয়ে এ শিল্পটিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে সরকারি- বেসরকারি এবং ক্রেতাদের বিভিন্ন উদ্যোগে। বাংলাদেশের পোশক খাত নিয়ে এমন আশার কথা শোনালেন আমেরিকার ক্রেতা জোট সংগঠন অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটির কান্ট্রি ডিরেক্টর এবং ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি। বিশ্বখ্যাত ওয়ালমার্ট, জেসিপেনি, টার্গেটের মতো ২৯টি ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান রয়েছে অ্যালায়েন্সের সঙ্গে।
কোনো দেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানাগুলো প্রথমদিকে অনেকটা অপরিকল্পিতভাবেই গড়ে ওঠে। চীনের পোশাক শিল্পের বেলায়ও যেমনটা দেখা যায়। তাহলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আপনি ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যালায়েন্সের কান্ট্রি ডিরেক্টর মরিয়ার্টি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বলার প্রধান কারণ হলো প্রথম দিকে উদ্যোক্তারা কারখানা তৈরির সময় ভবনের নিরাপত্তা নিয়ে খুব একটা গুরুত্ব দেননি।
ফলে বহুতল ভবনগুলোতে প্রয়োজনীয় অগ্নি নিরাপত্তা ছিল না। এমনকি দুর্ঘটনার সময় নিরাপদে বের হওয়ার দরজাও ছিল না। আর বাংলাদেশ ও চীনের অবস্থা এক নয়। কারণ এখানে জমির অনেক সংকট আছে। অন্যদিকে চীনে অনেক মানুষ একই সঙ্গে এবং অনেক বড় দেশ। তাদের প্রচুর খালি জমি রয়েছে। সেখানে যথেষ্ট জায়গা নিয়ে কারখানা করা হয়, যা এখানে পর্যাপ্ত নয়।
বিপুল জনগোষ্ঠীর ছোট এ দেশের কী করণীয় ছিল—এমন প্রশ্নের জবাবে মরিয়ার্টি বলেন, একটা বিষয় করা যায়, পোশাক কারখানাগুলোর জন্য রপ্তানি প্রক্রিয়া অঞ্চল করা। ওই সব অঞ্চলে এ খাতের জন্য সরকারের সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। অ্যালায়েন্সের ক্রেতারাও এমন একটি নিরাপদ পরিবেশ চান। আমরা আশা করছি, সরকার বিশেষ রপ্তানি অঞ্চল (এসইজেড) করছে, সেখানে পোশাক কারখানাগুলোকে স্থানান্তর করা হবে। তিনি বলেন, পোশাক খাতের আরো কিছু দুর্বলতা আছে। আর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো কারখানার কর্মপরিবেশ এবং এর নিরাপত্তাব্যবস্থা। সারা বিশ্ব তাকিয়ে আছে কত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশের পোশাক খাত কার্যকরভাবে নিরাপদ হবে। তবে আশার কথা, অ্যালায়েন্সের ২৯টি ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ ব্র্যান্ড বাংলাদেশের পোশাক কারখানা নিরাপত্তা নিয়ে বেশ সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তারা জানায়, এটা অন্য দেশগুলো থেকেও ভালো। তাই তারা এখানেই কাজ করতে চায়।
কারখানা সংস্কারে অ্যালায়েন্স ও অন্য দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সহায়তা করার কথা ছিল। কিন্তু উদ্যোক্তারা সে সহায়তা পায়নি। এ প্রসঙ্গে মরিয়ার্টি বলেন, কারখানা সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে অ্যালায়েন্স প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। কার্যক্রম বাস্তবায়ন, কারখানা পরিদর্শন, কারখানা ভবনের নকশা নিশ্চিত করা, শ্রমিক নিরাপত্তা নিয়ে প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কাজ রয়েছে। আর শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে রয়েছে হেলপ লাইন। এসব তো কারখানার সংস্কার তদারকিতে খরচ। কিন্তু সরাসরি কারখানা সংস্কারে কী পরিমাণে আর্থিক বিনিয়োগ বা ঋণ দেওয়া হয়েছে এ ব্যাপারে তিনি বলেন, প্রকৃত অর্থে কোনো দেশ এবং কোনো ক্রেতা এটা করার কথা নয়। এটা কারখানার মালিকরাই করবেন। তার পরও অ্যালায়েন্সের ২৯টি ব্র্যান্ড এ খাতের নিরাপত্তায় পাঁচ কোটি (৫০ মিলিয়ন) ডলার ব্যয় করছে। তিনি আরো বলেন, ক্রেতারা অনেক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ব্যবসা করে থাকেন। প্রকৃত অর্থে কারখানার সংস্কারে বিনিয়োগ করা তাঁদের কাজ নয়। তার পরও তাঁরা এগিয়ে এসেছেন রানা প্লাজা দুর্ঘটনার মতো মর্মান্তিক ঘটনার জন্য। কারণ এটা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনা। ক্রেতারা এখনো বাংলাদেশ থেকে পণ্য নিচ্ছেন। একই সঙ্গে এই শিল্পের উন্নয়নেও কাজ করছেন। এ ছাড়া কারখানা সংস্কারে আইএফসি প্রোগ্রামের মাধ্যমে ৫০ মিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল আছে।
অ্যালায়েন্সের সংস্কারকাজ নিয়ে মরিয়ার্টি বলেন, ‘আশা করছি, আগামী বছরের জুলাইয়ের মধ্যে সংস্কার শেষ হবে। ইতিমধ্যে ১৪৭টি কারখানার সম্পূর্ণ ত্রুটি সংশোধন করা হয়েছে (কারেক্টিভ অ্যাকশন প্ল্যান-সিএপি)। চলতি বছরের মধ্যে আরো তিন শ থেকে সাড়ে তিন শ কারখানার সিএপি সম্পন্ন হবে। অ্যালায়েন্সের মোট সক্রিয় কারখানার সংখ্যা ৬৭০টি। প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৫০টি করে সিএপি করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি আমরা। এ বছরের মধ্যে তিন শ থেকে সাড়ে তিন শ কারখানা সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত করা হবে। ’ তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের জুলাই মাসে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও সংস্কার কার্যক্রম কিভাবে চালু রাখা যায়—এ বিষয়টি নিয়ে আমরা বিজিএমইএ এবং আইএলওর সঙ্গে আলোচনা করছি। ’
তবে কারখানার নিরাপত্তা রক্ষায় ব্র্যান্ডগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এমন একটি কাঠামো দাঁড় করানো যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন। দেশের স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সেই সক্ষমতা আছে কি না জানতে চাইলে মরিয়ার্টি বলেন, হ্যাঁ এটা হতে পারে, ‘তবে তাঁরা কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন, বাইরের চাপে প্রভাবিত হবেন না। এমন সংশয় ক্রেতাদের রয়েছে। তাঁরা চান না, এতে বাইরের কোনো প্রভাব থাকুক।
প্রত্যাশিত এমন একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সরকার কী করতে পারে—এর জবাবে মরিয়ার্টি বলেন, সরকার বিজিএমইএ এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের রেমিডেশন কো-অর্ডিনেশন সেলকে (আরসিসি) এ খাতে কাজ করার সুযোগ করে দিতে পারে। সারা বিশ্বের ক্রেতারা বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে যে বাংলাদেশ এমন একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছে এর কর্মকর্তাদের কাজের সক্ষমতা আছে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারে। আর এর জন্য যেন বাইরের থেকে কোনো চাপ তৈরি না হয় তাঁদের ওপর।
ক্রেতাদের আশ্বাস ছিল, পোশাকের দাম বাড়ানো হবে কিন্তু প্রকৃত অর্থে বাড়ানো হয়নি—এ ব্যাপারে মরিয়ার্টি বলেন, ‘পোশাকের দর বাড়ানোর ব্যাপারে আমাদের কোনো ধারণা নেই। ’ তিনি আরো বলেন, গত অর্থবছরে বাংলাদেশের ব্যাপারে উত্তর আমেরিকার ক্রেতাগুলো বেশ সহায়ক ভূমিকা রেখেছেন। একমাত্র ভিয়েতনাম ছাড়া অন্য প্রায় সব দেশেরই যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকের রপ্তানি কমেছে।
জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল বিষয়ে মরিয়ার্টি বলেন, ‘তৈরি পোশাকে বাংলাদেশ কখনো জিএসপি সুবিধা পেত না। আর এ কারণে এ খাতে কোনো প্রভাবও পড়েনি। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নিয়েও কোনো সংকট নেই বলেও তিনি মন্তব্য করেন। জিএসপি ফিরে পেতে তাঁর পরামর্শ, এ জন্য দুই দেশের সরকারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমার মনে হয় কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। ’
মরিয়ার্টি বলেন, বিশ্বমানের অনেক আধুনিক শিল্প-কারখানা এখন বাংলাদেশে আছে। এখানকার কারখানাগুলোর নিরাপত্তা আগের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত হয়েছে। সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিতে হবে, বাংলাদেশ এখন নিরাপদ শিল্প-কারখানার প্রতীক। আমরা আমাদের ভবন এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি।