প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বল্প খরচে উন্নতমানের নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেটে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করতে পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটায় অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশনের কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন। এ ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ের (আইআইজি) মাধ্যমে ১ হাজার ৫০০ গিগাবাইট পার সেকেন্ড ডাটা আদান-প্রদান সম্ভব হবে। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাবমেরিন ক্যাবল (এসএমডব্লিউ-৫) এবং এর ল্যান্ডিং স্টেশন উদ্বোধন করেন। এর ফলে উন্নত ও দ্রুততর ইন্টারনেট সংযোগের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হলো বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারায় সন্তোষ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে তার সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশকে ডিজিটালাইজড করার যে পদক্ষেপ শুরু করেছিল এর মাধ্যমে তার একটি ধাপ পূর্ণ হলো। শেখ হাসিনা বলেন, বিনা খরচে বাংলাদেশ আইআইজির সঙ্গে যুক্ত হতে ১৯৯১ ও ১৯৯৪ সালে দুইবার সুযোগ পেয়েছিল, তবে বিএনপি সরকার দেশের ‘তথ্য ফাঁস’ হয়ে যাবে এ অজুহাতে ওই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। একটি অদক্ষ সরকারের অধীনে দেশ কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এটি তার সেরা নিদর্শন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল উন্নত ও দ্রুততর ইন্টারনেট সংযোগ পেতে জনগণের জন্য সহায়ক হবে।
আঞ্চলিক সাবমেরিন টেলি কমিউনিকেশন প্রজেক্টের প্রকল্প পরিচালক পারভেজ মনন আশরাফ জানান, বর্তমান সরকার দেশের ক্রমবর্ধমান গ্রাহকদের ইন্টারনেট সুবিধা এবং উচ্চগতিসম্পন্ন ব্যান্ডউইথ সেবা দিতে কুয়াকাটায় মাইটভাঙ্গা গ্রামে ২০১৩ সালে ১০ একর জমির ওপর ৬৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ কাজ শুরু হয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন। তথ্যপ্রযুক্তির মহাসড়কে যুক্ত হতে ২০১৪ সালের মার্চে মালয়েশিয়াকেন্দ্রিক সিমিইউ-৫ কনসোর্টিয়ামে যুক্ত হয় বাংলাদেশ। সমুদ্র তলদেশের ২৫ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর কুয়াকাটায় দেশের দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশনে সংযোগ স্থাপিত হয়। প্রথম সাবমেরিন ক্যাবলের চেয়ে প্রায় ৮ গুণ ক্ষমতাসম্পন্ন দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবলটির পরীক্ষামূলকভাবে সংযোগ চালু হয় চলতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি। উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এ সাবমেরিন ক্যাবল দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে বিপ্লব ঘটাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত ব্যান্ডউইথ বিদেশেও রফতানি করা সম্ভব হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পাশাপাশি সারা দেশে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখা সম্ভব হবে বলে আশা করেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর উপযুক্ত উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে দেশ গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত না হওয়ায়; এমনকি স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও বাংলাদেশ প্রত্যাশিত উন্নয়ন লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন স্বাধীনতার ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উন্নত দেশে পরিণত হতো। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে তার সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দেশকে এগিয়ে নিতে তার সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। তিনি উল্লেখ করেন, ঢাকা শহরের একটি ক্ষুদ্র অংশ বাদে গোটা দেশ ১৯৯৬ সালে এনালগ টেলিফোন সিস্টেমের আওতায় ছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর গোটা দেশের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ডিজিটালাইজড করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার দীর্ঘ সময় ধরে উপেক্ষিত এলাকা হিসেবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেয়। পরবর্তী সরকারগুলোর উপেক্ষার কারণে দেশের ‘খাদ্যভা-ার’ হিসেবে পরিচিত এ অঞ্চল সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমান সরকার এ অঞ্চলের উন্নয়নে বাড়তি গুরুত্ব দেয়ায় এখন এ অঞ্চল হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাচ্ছে। তার সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের সুরক্ষায় জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য সরকারের ধারাবাহিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৪ সালে সাংবিধানিক সরকারের ধারাবাহিকতা ছাড়া দেশকে বর্তমান উন্নয়নের পথে নিয়ে আসা সম্ভব হতো না।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী পটুয়াখালী জেলায় এলজিআরডি ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়নাধীন অনেকগুলো প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে কলাপাড়া সদর থেকে টিয়াখালী ঘাট বাজার ১৭৫ মিটার দীর্ঘ সেতু, রাঙ্গাবালী উপজেলা কমপ্লেক্স এবং কলাপাড়া উপজেলা পরিষদের প্রশাসনিক ভবনের সম্প্রসারণ। এলজিআরডি ও সমবায়মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, চিফ হুইপ এ এস এম ফিরোজ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, সংসদ সদস্য এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গণভবনে উপস্থিত ছিলেন। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা মাহবুবুর রহমান এমপি এবং শাহজাহান মিয়া, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব শ্যাম সুন্দর সিকদার, পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মাসুদুর রহমান এবং সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধাভোগী অনেক মানুষ পটুয়াখালী থেকে ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেন। পরে প্রধানমন্ত্রী ভারতের ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশে অতিরিক্ত ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহে দুইটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। এ বিদ্যুৎ দেশের ১০টি উপজেলা এবং কিছু প্রকল্পে শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করবে।
এদিকে বিদ্যুৎ ব্যবহারে জনগণকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার সারা দেশে বিদ্যুতের অপচয় রোধে প্রিপেইড মিটার অন্তর্ভুক্ত করবে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ একটি দেশ ও জনগণের সম্পদ। কাজেই আমি সবাইকে এটি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার অনুরোধ জানাব। প্রধানমন্ত্রী এদিন দুপুরে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ১০টি উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমের উদ্বোধনকালে এসব কথা বলেন। বিদ্যুতের অপচয় রোধে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে প্রিপেইড বিদ্যুতের মিটার ব্যবহারের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আমি সবাইকে বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটার ব্যবহারের অনুরোধ জানিয়ে বলব, এটা হলে সিস্টেম লস হবে না। আপনি যেটুকু বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন, শুধু সেটুকুরই বিল আপনাকে পরিশোধ করতে হবে। আর প্রয়োজন শেষে নিজের ঘরের বৈদ্যুতিক বাতি এবং ফ্যানের সুইচটি নিজ হাতে বন্ধ করে দিন। এ বিষয়ে আমি সবার সহযোগিতা কামনা করি।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আশুগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়াট নর্থ কম্বাইন্ড সাইকল, সিম্পল সাইকল প্লান্ট (উত্তর) এবং ১০৮ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কেরানীগঞ্জ ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। এছাড়া তিনি অনুষ্ঠানে ভারতের ত্রিপুরা থেকে রেডিয়াল মোডে অতিরিক্ত ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ কার্যক্রমও উদ্বোধন করেন। যেসব উপজেলা শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহের আওতায় এসেছে সেগুলো হচ্ছে, বাগেরহাটের মোল্লাহাট ও ফকিরহাট, দিনাজপুরের হাকিমপুর, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ ও সিলেট সদর, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, কিশোরগঞ্জের ভৈরব, চট্টগ্রামের সীতাকু- এবং নরসিংদী জেলার নরসিংদী সদর।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস একটি উপস্থাপনার মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক বিদ্যুৎ পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরেন। মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
ষ প্রতিবেদনটি তৈরিতে বাসস, চট্টগ্রাম ব্যুরো এবং পটুয়াখালী, নরসিংদী, বাগেরহাট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ঝিনাইদহ সংবাদদাতার সহায়তা নেয়া হয়েছে।