নাফ নদী পেরিয়ে আছড়েপড়া রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর ঢেউ ‘মানবিক’ দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, না ‘কূটনৈতিক’ কারণে তাদের আটকে রাখা উচিত? এই প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন সবদিক বিবেচনা করেই রাষ্ট্রনায়কোচিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। খোদ জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের এই অবস্থানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গা প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান সময়োচিত ও যথার্থ।
গত ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের শূন্যরেখায় এসে জড়ো হতে শুরু করলে প্রথম দিকে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি ও স্থানীয় প্রশাসন তাদের কড়া পাহারায় রেখেছিল। সীমান্ত এলাকায় ছিল কয়েক স্তরের নজরদারি। ওপাশে ভিড় বাড়তে থাকলে এবং আরাকানে সহিংসতার ব্যাপকতর মাত্রা স্পষ্ট হতে থাকলে ৪ সেপ্টেম্বর সোমবার সন্ধ্যার পর সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। গণভবনে রাত পৌনে ১০টা পর্যন্ত চলা ওই বৈঠকেই মূলত পরিস্থিতি সতর্কতার সঙ্গে মোকাবেলার সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় আগত উদ্বাস্তুদের সঙ্গে ‘অত্যন্ত মানবিক আচরণ’ করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। এ সংবাদটি শুধু সমকালেই ছাপা হয়েছিল। পরদিন সকাল থেকেই সীমান্তে শূন্যরেখায় পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে।
১৯৭৮ সাল থেকে দফায় দফায় রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের স্রোত বাংলাদেশমুখী হলে তৎকালীন সরকারগুলো যেভাবে বাধাহীন প্রবেশাধিকার দিয়েছে, সেটা ছিল কূটনৈতিক দিক থেকে অদূরদর্শী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন শুক্রবার সমকালকে বলেন, তৎকালীন সরকারগুলোর ভুল সিদ্ধান্ত
রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমাগত নাজুক করে তুলেছিল। শেখ হাসিনার দ্বিতীয় দফার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে ২০১২ সালে ফের রাখাইন স্টেট অস্থিতিশীল হয়ে উঠলে তিনি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করেন। একইসঙ্গে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। আবার সাম্প্রতিক সংকটে তিনি একদিকে যেমন প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা নারী-শিশুসহ রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন, তেমনই আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মহলের মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান খুঁজছেন। ড. হোসেনের মতে, এটাই ‘রাইট এপ্রোচ’ বা সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি।
বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বৈশ্বিক সংস্থাটির মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশের অবস্থানের ভুয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ যে তারা শরণার্থীদের প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। সম্প্রতি জনস্রোতের জন্য প্রয়োজনীয় এই অবস্থান উৎসাহব্যঞ্জক।’ মঙ্গলবার বাংলাদেশ সফরে এসে তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিনে এরদোয়ানও মানবিকতা প্রদর্শনের জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রশীদ সমকালকে বলেন, এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। তিনি মনে করেন, শেখ হাসিনা কূটনীতি ও মানবিকতার মধ্যে এক ‘দারুণ ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা’ করতে সক্ষম হয়েছেন।
শেখ হাসিনার জন্য এই সিদ্ধান্ত স্পষ্টতই সহজ ছিল না। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে আটকে থাকা রোহিঙ্গারা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত দিক থেকে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ওপর আরও তিন লাখ রোহিঙ্গার দায়িত্ব নেওয়া নিম্ন-মধ্যম আয়ের একটি দেশের পক্ষে খুবই কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকেও বাংলাদেশের এই পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে মুখপাত্র হিদার নোয়ার্ট বলেন, ‘শরণার্থী বহন করা বাংলাদেশের জন্য একটি কঠিন পরিস্থিতি।’
সীমান্ত এলাকায় মানবিকতা প্রদর্শনের পাশাপাশি শেখ হাসিনার সরকার কূটনৈতিকভাবেও পরিস্থিতি মোকাবেলায় সর্বাত্মক উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষের কাছে চিঠি পাঠিয়ে বাংলাদেশ জানিয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যেই যাতে একটি ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ তৈরি হয়। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব দেশগুলোর আঞ্চলিক জোট আসিয়ান ও মুসলিম দেশগুলোর সংস্থা ওআইসির সঙ্গে কূটনৈতিক চ্যানেলে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ উদ্যোগী হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক উদ্যোগে ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠা হলে সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গারা সেখানেই নিরাপদে থাকতে পারবে। উদ্বাস্তুদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দিলেও কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এই অবস্থান পরিবর্তন করেনি যে, রোহিঙ্গাদের রাখাইনেই ফেরত যেতে হবে। তাদের ভার বাংলাদেশ অনির্দিষ্টকালের জন্য বহন করতে পারবে না।
বস্তুত দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সংকট কূটনৈতিকভাবে মোকাবেলায় উদ্যোগী হয়েছেন। সম্প্রতি গঠিত কফি আনান কমিশনকেও এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছে ঢাকা। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দিয়েই বাকি আলোচনা অগ্রসর হতে পারে_ আনান কমিশনের এই সুপারিশে বাংলাদেশেরই অবস্থানের প্রতিফলন ঘটেছে।
কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে চতুর্মুখী উদ্যোগ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথমত, সরাসরি মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে আলোচনা অব্যাহত রাখা। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর সমর্থন ও সহায়তা লাভে প্রচেষ্টা। তৃতীয়ত, বহুপক্ষীয় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা। জাতিসংঘ, ওআইসি, ইইউ এবং আসিয়ানের মতো জোটে রোহিঙ্গাদের অধিকার, তাদের ওপর পরিচালিত নিপীড়ন এবং শরণার্থীদের আশ্রয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সীমিত সামর্থ্য তাদের মনে করিয়ে দেওয়া। চতুর্থত, আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে যাতে করে রাখাইনের চিত্র সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাবশালী ঢাকায় বিভিন্ন দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক সংস্থার দপ্তরের সঙ্গে এ ব্যাপারে নিয়মিত কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
মেজর জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রশীদ মনে করেন, কূটনীতি ও মানবিকতার মিশ্রণে বাংলাদেশের অবস্থান রোহিঙ্গা সংকটে ইতিমধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতায় স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রভাবশালী পক্ষ রোহিঙ্গা ইস্যুতে উচ্চকণ্ঠ হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও যে চিত্র উঠে আসছে, তাতে বাংলাদেশের মানবিক ভাবমূর্তিই ফুটে উঠছে। এই স্রোত বাংলাদেশের পক্ষে যে একা সামলানো সম্ভব নয়, তাও স্বীকার করে নিচ্ছে আন্তর্জাতিক মহল।
অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন মনে করেন, এখন প্রয়োজন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অন্যান্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার সমন্বয়। একই সঙ্গে নাগরিক সমাজের কণ্ঠস্বরও যাতে স্পষ্ট হয়, সরকারকে সেই উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ কূটনৈতিক কারণে যেসব বার্তা সরকার তুলে ধরতে পারে না, নাগরিক সমাজ তা পারে। একই সঙ্গে বাংলাদেশকে বর্তমান অবস্থান ধরে রাখতে হবে। বিশেষত আন্তর্জাতিক মহল যাতে উদ্বাস্তুদের মানবিক সহায়তায় এগিয়ে আসে ও অব্যাহত রাখে, তা নিশ্চিত করতে হবে।