হাঁটু ও কোমর প্রতিস্থাপনে সবচেয়ে কম ব্যয় বাংলাদেশে হাঁটু ও কোমর প্রতিস্থাপনে সবচেয়ে কম ব্যয় বাংলাদেশে
বছর ছয়েক আগে শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে আকস্মিক দুর্ঘটনায় পড়েন মার্কিন নাগরিক জয়েস হোয়াইট। কোমরের জয়েন্ট ভেঙে গেলে শরণাপন্ন হন ল্যাবএইড হাসপাতালের। কোমর প্রতিস্থাপন শেষে ফিরে যান যুক্তরাষ্ট্রে। দেশে ফিরেই ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি লেখেন তার চিকিত্সক ডা. আমজাদ হোসেনকে। চিঠিতে আবারো বাংলাদেশে আসার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন জয়েস। তবে বেড়াতে নয়, এবার হাঁটু প্রতিস্থাপন করাতে চান তিনি।
বাংলাদেশে কোমর প্রতিস্থাপনে জয়েস হোয়াইটের খরচ হয়েছে সাকল্যে সাড়ে ৪ লাখ টাকা বা ৫ হাজার ৬০০ ডলার। এত কম খরচে চিকিত্সাটি নিতে পেরে রীতিমতো বিস্মিত এ মার্কিন নাগরিক। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে হাঁটু প্রতিস্থাপনে তার ব্যয় হয় ৪১ হাজার ডলার। ডা. আমজাদ হোসেনকে তাই ফি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন জয়েস হোয়াইট।
বাংলাদেশে কোমর প্রতিস্থাপনে জয়েস হোয়াইট সাড়ে ৪ লাখ টাকা ব্যয় করলেও ক্ষেত্রবিশেষে এ খরচ আরো কম। বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে হাঁটু বা কোমর প্রতিস্থাপন খরচ আড়াই থেকে ৪ লাখ টাকা (৩-৫ হাজার ডলার)। এর মধ্যে ইমপ্লান্ট খরচ পড়ে এক-দেড় লাখ টাকা। বাকিটা হাসপাতাল, ওষুধ ও চিকিত্সকের খরচ। এ ধরনের চিকিত্সায় এটাই বিশ্বে সবচেয়ে কম ব্যয়।
এশিয়ার বিভিন্ন দেশে হাঁটু বা কোমর প্রতিস্থাপন ব্যয়ের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, সিঙ্গাপুরে এজন্য ব্যয় হয় ২৭ হাজার, থাইল্যান্ডে ২০ হাজার ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৬-২০ হাজার ডলার। ভারতের বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় হাঁটু বা কোমর প্রতিস্থাপনে খরচ পড়ে ৯-১২ হাজার ডলার। হায়দরাবাদের গ্লেইগলস হসপিটালস লিমিটেডে হাঁটু প্রতিস্থাপনের খরচ উল্লেখ করা হয়েছে ৯ হাজার ডলার। তবে ভারত সরকার সম্প্রতি হাঁটু প্রতিস্থাপন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আনার ঘোষণা দিয়েছে। কোমর প্রতিস্থাপন ব্যয়ও কমিয়ে আনার কথা ভাবছে দেশটি।
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইতালিতে কোমর প্রতিস্থাপনে খরচ পড়ে ১৪ থেকে ৫৮ হাজার ডলার। স্পেনে এ ব্যয় ২০ হাজার, পোল্যান্ডে ১৯ ও তুরস্কে ১২ হাজার ডলার। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোয় হাঁটু ও কোমর প্রতিস্থাপনে ব্যয় হয় গড়ে ৪৫ হাজার ডলার।
দেশের হাঁটু ও কোমর প্রতিস্থাপনে সাফল্যের হারও লক্ষণীয়। হাঁটু ও কোমর প্রতিস্থাপনের পর অনেকেই স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। এমনই একজন গাজীপুরের স্বপ্না মাহমুদ। নন-হিস্টোন ক্যান্সার চিকিত্সায় চারটি কেমো নেয়ার পাঁচ বছর পর দুই পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করতে থাকেন তিনি। ব্যথায় হাঁটাচলা যখন বন্ধের জোগাড়, তখন বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন স্বপ্না। এক চিকিত্সক বন্ধুর পরামর্শে পরে মত বদলান। রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ২০১৩ সালে কোমর প্রতিস্থাপন করেন তিনি। আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতোই জীবন যাপন করছেন ২৮ বছর বয়সী স্বপ্না। অস্ত্রোপচারের আড়াই বছর পর একটি পুত্রসন্তানের মাও হয়েছেন তিনি।
১৯৯৩ সালে এসএসসি পরীক্ষার আগে পায়ে তীব্র ব্যথার কারণে হাঁটাচলা প্রায় বন্ধের উপক্রম হয় সিলেটের বিয়ানীবাজারের বাসিন্দা আবদুল বাসিত জুয়েলের। চিকিত্সার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনাও করেন। বিদেশে চিকিত্সা ব্যয় অত্যধিক হওয়ায় সে পরিকল্পনা থেকে সরে আসেন জুয়েল। পরে স্থানীয় এক চিকিত্সকের পরামর্শে ২০০৮ সালে ঢাকায় আসেন তিনি। রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ২০১৫ সালে অস্ত্রোপচার করে তার কোমর প্রতিস্থাপন করা হয়। সুস্থ হয়ে ৪০ বছর বয়সী জুয়েল এখন ভাইয়ের ব্যবসা তদারক করছেন।
এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি রোগীর হাঁটু ও কোমর প্রতিস্থাপন করেছেন ল্যাবএইড হাসপাতালের চিফ কনসালট্যান্ট অধ্যাপক ডা. এম আমজাদ হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ২০০৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৩০০ রোগীর হাঁটু ও কোমরের জয়েন্ট প্রতিস্থাপন করেছি। এর মধ্যে ৩০ বছরের নিচের রোগী রয়েছেন চার শতাধিক। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং উন্নত ও দীর্ঘমেয়াদি কৃত্রিম অস্থিসন্ধি ব্যবহার করে অল্প বয়সী রোগীদের হাঁটু ও কোমর প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে।
দেশে কম খরচে সফলভাবে হাঁটু ও কোমর প্রতিস্থাপন হলেও রোগীদের মধ্যে দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা এখনো বেশি। এর কারণ জানতে চাইলে ডা. আমজাদ হোসেন বলেন, দেশে এ ধরনের অস্ত্রোপচার যে সফলভাবে হচ্ছে, অনেকেই তা জানেন না। এ কারণেই তারা বিদেশমুখো হচ্ছেন। সাফল্যের এসব গল্প ফলাও করে প্রচার হওয়া প্রয়োজন। গণমাধ্যম এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।
চিকিত্সকদের ভাষায়, কোমরের ইনজুরি, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অস্টিওআর্থ্রাইটিস, হাড়ের ক্ষয় ও হাড়ের টিউমারের কারণে কোমর প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়। কোমর প্রতিস্থাপন বেশি করা হয় বয়স্কদের। এছাড়া যারা হাঁটাচলা কম করেন ও দীর্ঘ সময় হাঁটু ভাঁজ করে কাজ করেন, তাদের পায়ে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। একপর্যায়ে হাঁটাচলার পাশাপাশি নড়াচড়াও বন্ধ হয়ে যায়। কোমর প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে এসব রোগীকে সুস্থ করা হয়। কোনো কারণে হাঁটু অকার্যকর হয়ে গেলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তা অপসারণ করে ধাতব বা প্লাস্টিকের কৃত্রিম হাঁটু প্রতিস্থাপন করা হয়।
১৯৮০ সালের শেষ দিকে পরীক্ষামূলকভাবে পঙ্গু হাসপাতালে দু-একটি অস্ত্রোপচার করা হয়। প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাবে সেটি খুব একটা এগোয়নি। ১৯৯৮ সালের পর বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের চিকিত্সকদের যোগাযোগ বাড়ায় এ দেশেও এসব অস্ত্রোপচারের কথা ভাবতে থাকেন তারা। ২০০০ সালে দেশে হাঁটু ও কোমর প্রতিস্থাপন শুরু হয়।