কম ওজনের নবজাতক ও স্বল্প খরচে ক্যান্সার চিকিৎসার অনন্য প্রতিষ্ঠান

নয় বছরের শিশু রাজন, বাড়ি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায়। বাবা রহমান মিয়া রিকশা চালান, মা কাজ করেন বাসা বাড়িতে। এমন সংসারে একমাত্র ছেলের ব্লাড ক্যান্সার। নিজে ভূমিহীন হলেও পরের জায়গায় মাথা গোজার জন্য একটা ঘর তুলেছিলেন। রাজনের প্রাথমিক চিকিৎসার খরচ মেটাতেই বিক্রি করতে হয়েছে সেটিও। এখানে-ওখানে ঘুরে শেষ পর্যন্ত রাজনের ঠাঁই হয়েছে ঢাকা শিশু হাসপাতালে। এখন হাসপাতালের ডাক্তারদের আর্থিক ও মানসিক সহায়তাই চিকিৎসা চলছে রাজনের।

শুক্রবার ঢাকা শিশু হাসপাতালের হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, রাজনের মতো আরো অনেক শিশু ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছে। এদের বেশিরভাগই গ্রাম থেকে এসেছে চিকিৎসা সেবা নিতে। ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যয়বহুল হলেও রোগীর স্বজনরা জানিয়েছেন, ঢাকার অন্য হাসপাতালের তুলনায় শিশু হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসার খরচ অনেক কম, তাই চিকিৎসা সেবার জন্য এই হাসপাতালকেই বেছে নিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন জানান, খাদ্যে ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদান, খাদ্য সংরক্ষণের জন্য মিশ্রিত বিষাক্ত পদার্থ, খাদ্যে ভেজালের কারণেও ক্যান্সার হয়। তিনি জানান, দ্রুত রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা শুরু করা গেলে ক্যান্সারে আক্রান্ত সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যেতে পারে। তিনি জানান, রোগের তীব্রতা অনুপাতে এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা খরচেও ক্যান্সারের চিকিৎসা দিয়ে থাকে তার প্রতিষ্ঠান।

কেবল ক্যান্সারই নয়, কম ওজন নিয়ে জন্মানো শিশুদের চিকিৎসায়ও হাসপাতালটি অনন্য। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রান্তিক উপজেলা বা গ্রামগুলোতে শতকরা ৩০ ভাগ শিশু কম ওজন নিয়ে জš§ নেয়। কিন্তু এসব শিশুর চিকিৎসার জন্য উপজেলা বা গ্রামে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা নেই। যার কারণে প্রতিবছর অনেক শিশু কম ওজনজনিত কারণে মারা যায়। এছাড়া এ চিকিৎসার ব্যয়ও অনেক বেশি। যা অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে ঢাকা শিশু হাসপাতাল অল্প খরচে এদের চিকিৎসা দিয়ে থাকে।

ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা শিশু হাসপাতাল। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৬ সালে এটি স্থানান্তরিত হয় শ্যামলীতে। এই হাসপাতালটি বর্তমানে দেশের বৃহত্তম স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতাল। ৬৫০ শয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতালের প্রায় অর্ধেকই নন-পেয়িং রোগী। গ্রাম ও মফস্বল থেকে আসা রোগীদের জন্য এখানে সুবিধাও ঢাকার অন্য হাসপাতালের তুলনায় বেশ ভালো।

কুমিল্লা থেকে বোনের বাচ্চা নিয়ে এসেছেন মরিয়ম আক্তার। বর্তমানে শিশুটিকে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে। মরিয়ম আক্তার জানান, তিনি শিশুটিকে নিয়ে এসেছেন আজ তিন দিন। যখন শিশুটিকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় তখন তার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। অনেকেই বলছিল শিশুটিকে বাঁচানো যাবে না। আবার কেউ বলেছেন খরচ অনেক। এখন পর্যন্ত ওষুধ খরচ ছাড়া আর কোনো খরচ হয়নি। ডাক্তাররা বলছেন, অর্থ নয়, শিশু সুস্থতাই আমাদের লক্ষ্য।

এ বিষয়ে হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন বলেন, এখানে শিশুদের সেবা দিতে ডাক্তাররা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। একজন শিশুও যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যায় এদিকটা খেয়াল রাখতে ডাক্তারদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যাদের টাকা আছে তারা টাকা দিয়ে চিকিৎসা করবে, যাদের নেই তারাও যেন চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হয় সেই দায়িত্বও হাসপাতালের।

১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত শিশু হাসপাতালের পরিচালক ছিলেন ডা. মনজুর হোসেন। এরপর ২০১০ সালে আবার দায়িত্ব নেন তিনি। দ্বিতীয় দফায় দায়িত্ব নেয়ার পর হাসপাতালটির অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন হয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হাসপাতালটিকে ৩৫০ শয্যা থেকে ৬৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ। এছাড়াও গত সাত বছরে বেশ কয়েকটি নতুন বিভাগ চালু করেন তিনি। ক্যান্সার চিকিৎসাসহ শিশুদের সব ধরনের সার্জারি ও রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখানে রয়েছে।

ডা. মনজুর বলেন, শিশুদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে এখানকার ডাক্তারদের চেষ্টার কমতি নেই। তবে অর্থ সংগ্রহে মাঝে মাঝেই ঝামেলায় পড়তে হয়। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত তহবিল বরাদ্দ দেয়া হলেও তা হাসপাতালের মোট ব্যয়ের তুলনায় কম। ফলে নিজেদেরও অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করতে হয়।

এ বিষয়ে হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. জিয়াউল ইসলাম বলেন, হাসপাতাল পরিচালনার পাশাপাশি অর্থ সংগ্রহের কাজ বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু শিশুদের বিশেষ করে প্রান্তিক অঞ্চলের গরিব শিশুদের অল্প টাকায় সেবা দিতে হলে হাসপাতালটির জন্য প্রচুর পরিমাণে অনুদান সংগ্রহ করতে হবে। তবে এই কাজটি বেশ ভালোভাবেই করছেন পরিচালক ডা. মনজুর।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, অপুষ্টির কারণে বাংলাদেশে ৩৬ শতাংশ শিশু স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজন নিয়ে জš§গ্রহণ করে আর ৪১ শতাংশ শিশু বেড়ে ওঠে বিকলাঙ্গ হয়ে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যেই এমনটা ঘটতে দেখা যায় বেশি।
ডা. মনজুরুল ইসলাম বলেন, কম ওজনের নবজাতকের চিকিৎসা ব্যয় অনেক। যেসব নবজাতক কম ওজন নিয়ে জন্মায় তাদের প্রয়োজন হয় তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সেবা। নয়তো অধিকাংশ সময় নবজাতককে বাঁচানো সম্ভব হয় না। অথবা বাঁচলেও শিশুটি বিকলাঙ্গ হবার ঝুঁকি থেকে যায়। খরচের ভয়ে অনেকে হাসপাতালে আসতে চায় না। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি সমাজের সচেতন ও বিত্তশালীদের এগিয়ে আসতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

ঢাকা শিশু হাসপাতালে বর্তমানে বেশ কয়েকটি বিভাগে বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছে শিশু নিবিড় পরিচর্যা বিভাগ, শিশু হৃদরোগ কেন্দ্র, পেড্রিয়েট্রিক কার্ডিয়াক ইনটেনসিভ কেয়ার, ক্রিটিকাল কেয়ার (কিডনি) ও ডায়ালাইসিস, থ্যালাসেমিয়া কেন্দ্র।

প্রতিটি ডিভিশনের সেবার মানই বেশ ভালো বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে এটিকে নিজের ‘কর্তব্য’ উল্লেখ করে ডা. মনজুর জানান, কর্তব্য পালনে তিনি নিরলসভাবে চেষ্টা করে যাবেন। ভবিষ্যতেও হাসপাতালটির চিকিৎসা সেবার মান ধরে রাখতে কাজ করে যাবেন বলে তিনি জানান।