জামদানির পর ইলিশের ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেল বাংলাদেশ। আগামি এক সপ্তাহের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে মত্স্য অধিদপ্তরের হাতে ইলিশের জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের সনদ তুলে দেওয়া হবে। এর ফলে স্বাদে অতুলনীয় ঝকঝকে রুপালি ইলিশ বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে সারাবিশ্বে স্বীকৃতি পাবে। সেইসাথে দেশীয় ঐতিহ্য সুরক্ষার পথে বাংলাদেশ আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল।
উল্লেখ্য, কোনো একটি দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং ওই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উত্পাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। গত বছরের নভেম্বরে দেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পায় জামদানি। এই নিবন্ধনটি দেয় আন্তর্জাতিক মেধাসম্পদ বিষয়ক সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অরগানাইজেসন’ (ডব্লিউআইপিও)। আর তাদের মাধ্যমে স্থানীয় ভাবে কাজটি করে থাকে সদস্য দেশগুলোর পেটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অফিস।
ইলিশের একক মালিকানা পাওয়ার লক্ষ্যে ২০১৬ সালের ১৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিকভাবে জিআই নিবন্ধনের জন্য সরকারের পেটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদফতরে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করে মত্স্য অধিদফতর। তথ্য-প্রমাণাদি যাচাই ও বিশ্লেষণের পরে চলতি বছরের ১ জুন নিজস্ব জার্নালে ৪৯ পৃষ্ঠার একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে পেটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদফতর। আশঙ্কা ছিল প্রতিবেশী দেশ ভারত বা মিয়ানমার ইলিশের জিআই নিবন্ধনের ব্যাপারে আপত্তি জানাতে পারে। তবে শেষপর্যন্ত আপত্তি তোলেনি কোন দেশই।
পেটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদফতরের রেজিস্টার মো. সানোয়ার হোসেন ইত্তেফাককে জানান, জার্নালে নিবন্ধ প্রকাশের পর বাধ্যতামূলকভাবে দুই মাস অপেক্ষা করতে হয়। আইন অনুসারে গেজেট প্রকাশিত হওয়ার দুই মাসের মধ্যে দেশে বা বিদেশ থেকে এ বিষয়ে আপত্তি জানাতে হয়। কিন্তু এ বিষয়ে কেউ কোনো আপত্তি জানায়নি। তাই আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা বাংলাদেশকে ইলিশের নিবন্ধন দিতে যাচ্ছি।
মত্স্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, সারা বিশ্বে যে ইলিশ উত্পাদিত হয় তার সিংহভাগের উত্পাদনকারী বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ইলিশ রক্ষায় পাইওনিয়র। ইলিশের স্বত্ব পাওয়ার মধ্যে দিয়ে সেটারই স্বীকৃতি মিললো।
প্রসঙ্গত, ভিয়েতনাম থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃতি থাকলেও বাংলাদেশেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে। দেশের মোট মত্স্য উত্পাদনে ইলিশের অবদান প্রায় ১০ শতাংশ এবং দেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে (জিডিপি) ইলিশ মাছের অবদান প্রায় ১ শতাংশ। ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৬৫ শতাংশ উত্পাদিত হয় বাংলাদেশে। ভারতে ১৫ শতাংশ, মিয়ানমারে ১০ শতাংশ, আরব সাগর তীরবর্তী এবং প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগর তীরবর্তী দেশগুলোতে বাকি ইলিশ ধরা পড়ে। তবে বিশ্বেও অন্য দেশগুলোতে ইলিশের উত্পাদন কমলেও বাংলাদেশে বাড়ছে। এই বৃদ্ধির হার প্রতিবছর ৮ থেকে ১০ শতাংশ।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইইডি), বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস) ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ যৌথভাবে ইলিশের খাদ্যবহির্ভূত মূল্য নিয়ে সমপ্রতি একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, খাদ্য ছাড়াও ইলিশের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও জীবিকা সৃষ্টির মূল্য রয়েছে। এতে খাদ্যবহির্ভূত গুরুত্বের মূল্যমান দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৮৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, দেশের প্রায় ৫ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা প্রত্যক্ষভাবে ইলিশ আহরণের ওপর নির্ভরশীল। পাশাপাশি ইলিশ প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন ও বিপণনের সঙ্গে আরও ২৫ লাখ মানুষ পরোক্ষভাবে যুক্ত রয়েছে।
মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাবে, দেশের ২৫টি নদীতে ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। এরমধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত পদ্মার ইলিশ। তবে পদ্মায় এখন তুলনামূলক কম ইলিশ পাওয়া যায়। বর্তমানে মেঘনা অববাহিকার ২০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সবচেয়ে বেশি ইলিশ পাওয়া যায়।