ক্যামেরার লেন্সে মুবাশশিরের স্বপ্ন

বিশ্ববিদ্যালয়ে এক কঠিন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। অন্যরা যেখানে বই আর ক্লাস ছাড়া কিছু বোঝেন না-দেখেন না, সেখানে তার জগৎ হলো ক্যামেরার দুনিয়া। ক্যামেরার লেন্স দিয়েই পুরো দুনিয়া দেখেন তিনি। নাম তার এমএইচএম মুবাশশির। মুবাশশির ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োটেকনোলজি বিষয়ে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি টেকনোলজিতে বায়োইনফরমেটিক্স বিষয়ে এমফিল করতে যান। মালয়েশিয় সরকারের আন্তর্জাতিক বৃত্তি নিয়ে পড়েছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫ সালের ধারণা-কল্প উপস্থাপন প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম, লেকচার প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েছেন। পড়ার দুনিয়ার বাইরে সিনেমা, ডকুমেন্টারি, ফটোগ্রাফি, বিতর্ক, লেখালেখি, গান, আবৃত্তি, অভিনয়সহ লেখাপড়ার বাইরে যত রোমাঞ্চকর কাজ আছে, সবকিছুতেই আগ্রহ তার। তার ভাষ্যে, পড়ালেখা সবাই করে। আমিও করি। কিন্তু আমি তার বাইরে কিছু করতে চাই।

সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও পড়াশোনা
এমএইচএম মুবাশশির। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদে স্নাতক করেন এবং বায়োটেকনোলজি বিভাগে মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে মালয়েশিয়ান সরকারের বৃত্তিতে ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মালয়েশিয়াতে বায়োসায়েন্সে এমফিল করতে যান। পড়ালেখা এবং রিসার্চে আউটস্টেন্ডিং পারফর্মেন্সের কারণে সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মালয়েশিয়ার ৫৮তম কনভোকেশনে তিনি গোল্ড মেডেলসহ বেস্ট স্টুডেন্ট অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। জন্ম এবং শৈশবে বেড়ে ওঠা ময়মনসিংহে। ২য় শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় স্কুলের সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় ২য় হোন। এছাড়া পঞ্চম শ্রেণী থেকে মঞ্চ অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হোন। স্কুলে থাকতেই কবিতা আবৃতিতে জেলা পর্যায়ে প্রথম হোন। কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় আবৃতি, অভিনয় ও দেশাত্মবোধক গান এই তিনটি বিভাগে অংশগ্রহণ করে তিনটিতেই পুরষ্কার জিতে নেন মুবাশশির। পরবর্তীতে কলেজ ২য় বর্ষে থাকা অবস্থায় রচনা প্রতিযোগিতায় সমগ্র দেশে ১ম হোন। এছাড়া কলেজের নবীনবরণ অনুষ্ঠানের অন্যতম সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম বর্ষের অরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠানে নবীন ছাত্রদের পক্ষ থেকে বক্তৃতা দিয়ে এবং পরবর্তীতে একাডেমীতে ভালো রেজাল্টের করে শিক্ষক মহলে ছাত্র হিসেবে ব্যাপক সমাদৃত হন মুবাশশির। পরবর্তীতে ১ম সেমিস্টার সমাপনী অনুষ্ঠানে অভিনয় করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনে যোগদান করার আমন্ত্রণ পান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর থেকে গান, অভিনয় থেকে পরিচালনা বেশি টানে তাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষে থাকা অবস্থায় ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর তিনি এবং সহপাঠী এমআই জুয়েল প্রতিষ্ঠিত করেন তাদের চলচ্চিত্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ‘জলছবি ফিল্মস’। ‘জলছবি ফিল্মস’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার চলচ্চিত্র পরিচালনার যাত্রা শুরু হয়। একে একে নির্মাণ করেন ‘ইনসাইট’, ‘অন্তরালে’ সহ মেধাবী সব নির্মাণ। পরবর্তীতে প্রফেশনাল ভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তিনি এবং সহপাঠী জুয়েল মিলে নির্মাণ করেন ভিডিও ফিকশন ‘স্বপ্ন সমীকরণ’ যা জাতীয় টিভি চ্যানেল এসএটিভিতে সম্প্রচারিত হয়। এতে অভিনয় করেন মোশাররফ করিম, স্বাধীন খসরু হক, সাহেদ আলী, রিফাত চৌধুরী, দীপান্বিতাসহ জনপ্রিয় টিভি অভিনেতা ও অভিনেত্রী। পরবর্তীতে জলছবি ফিল্মসের ব্যানারে ডকুমেন্টারি, শর্টফিল্মসহ বেশ কিছু টিভি কমার্শিয়াল নির্মাণ করেন।

মালয়েশিয়াতে মুবাশশির
সম্প্রতি মালয়েশিয়াতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশি ছাত্রদের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম ‘বাংলাদেশ স্টুডেন্টস নাইট’ এ আউটস্টেন্ডিং কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন এমএইচএম মুবাশশির। পড়ালেখার পাশাপাশি অন্যান্য কো-কারিকুলার বিভাগে অসামান্য অবদান এবং অর্জনের জন্য তাকে এই পুরষ্কার প্রদান করা হয়। এমএইচএম মুবাশশির ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মালয়েশিয়ায় অধ্যয়নরত অবস্থায় বিভিন্ন ভলান্টিয়ার কার্যক্রম যেমন ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক ছাত্রদের অফিসিয়াল সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস সোসাইটি’ এর হেড অফ কালচার; মালয়েশিয়ায় অধ্যয়নরত বাংলাদেশি ছাত্রদের সবচেয়ে বড় সংগঠন ‘বাংলাদেশ স্টুডেন্টস ইউনিয়ন মালয়েশিয়া’ এর ভাইস প্রেসিডেন্ট; নিজ ফ্যাকাল্টি, ফ্যাকাল্টি অফ বায়োসায়েন্স এন্ড মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ‘পোস্টগ্রেড স্টুডেন্ট সোসাইটি’ এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মালয়েশিয়ার বাংলাদেশি ছাত্রদের অফিসিয়াল সংগঠন ‘বাংলাদেশ স্টুডেন্টস সোসাইটি’ এর হেড অফ কালচারের দায়িত্ব পালন করেন।

এমএইচএম মুবাশশির ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মালয়েশিয়ার একমাত্র ছাত্র যিনি ‘ওয়ার্ল্ড লেকচার কম্পিটিশন’ এর ফাইনাল রাউন্ডে (ন্যাশনাল লেভেল) কোয়ালিফাই করেন এবং ব্রোঞ্জ অ্যাওয়ার্ড জেতেন। এছাড়াও তিনি ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মালয়েশিয়া আয়োজিত ম্যাটেরিয়াল লেকচার কম্পিটিশনে প্রথম, প্রপোজাল প্রেজেন্টেশন কম্পিটিশনে প্রথম, টিএনসি গ্র্যান্ড ডিবেট কম্পিটিশনে রানারআপ, আইইএম ওয়াটার এয়ারনেস কম্পিটিশনে ২য় রানারআপ এবং উবার আয়োজিত উবার কনসেপ্ট কম্পিটিশনে ১ম হন এবং ‘এশিয়া গট ট্যালেন্টে’ অংশগ্রহণের জন্য মনোনয়ন পান।

তার উল্লেখযোগ্য কাজ
ডিপেন্ডেন্স: ‘৯.৮৮ আল্ট্রা শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ ২০১৪ এর জানুয়ারিতে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর ফিল্মমেকারদের কাছ থেকে শর্টফিল্ম আহবান করে। তারই ধারাবাহিকতায় ইউকে, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, পাকিস্তান, ভারত, সিঙ্গাপুর, নাইজেরিয়া, মালয়েশিয়াসহ কমনওয়েলথভুক্ত বিভিন্ন দেশগুলো থেকে জমাকৃত ৫৯২টি শর্টফিল্মের মধ্যে মুবাশশিরের ডিপেন্ডেন্স ৩য় স্থান লাভ করে। এই সাফল্যে মুবাশশিরকে মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী, রেদওয়ান রনি, সামির আহমেদসহ দেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্র নির্মাতা সাধুবাদ জানান। ডিপেন্ডেন্স এর রচনা, চিত্রনাট্য ও সুপারভিশন করেন তার মাস্টার্সের ক-সুপারভাইজার ডঃ নাজমুল হক শাহীন। শর্টফিল্মটির দৈর্ঘ্য ১০ সেকেন্ড মাত্র।
দ্য ক্লে: উদীয়মান লেখক হুমায়ন কবীর এর মূলভাবনা এবং তরুণ কবি ও নাট্যকার আসম্মা শাওন এর গল্প, চিত্রনাট্য ও সংলাপ অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে এই চলচ্চিত্রটি। অভিনয় করেছেন ‘ওমর ফারুক, শামীম হাসান সরকার, মাকসুদা তিশা, আহমেদ রিপন, শারমিন শিমু, আমিন আকবরীসহ আরও অনেকে। ১৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রটির গল্পে দেখা যায়-

প্রকৃতি, পরিবেশ ও সময়ের ব্যবধানের স্রোতে ভেসে গেছে বাংলার কৃষ্টি সংস্কৃতি। ফলে বাংলায় ঢুকে গেছে অপসংস্কৃতি। আগেকার বাঙ্গালী সারাদিন শত খাট-খাটুনির পর ক্লান্ত হয়েও অপেক্ষায় থাকতো একটি সন্ধ্যার জন্যে। কখন হবে সন্ধ্যা। আর কখন শুনবে মাটির গান, জুরাবে তাদের প্রাণ। এখনকার মানুষ গানশোনার সময় পায় না। শুধু শহর নয় প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে যায় বিদেশী টিভি চ্যানেল। আজ কাদা মাটির দেশে প্রবেশ করেছে পোড়া মাটি। এ পোড়া মাটি আজ পুড়ে তৈল করে দিচ্ছে বাঙ্গালীর রক্ত মাংস ‘দ্য ক্লে’ এমনই একটি জীবন ও বাস্তবতা।

চলচ্চিত্রটি চিত্রগ্রহণে আছেন বিদ্রোহী দীপন ও এমএইচএম মুবাশশির এবং সুপারভিশনে আছেন এইচ আল বান্না। সম্পাদনায় ছিলেন এইচ আল বান্না এবং শেখর। এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার পাপ্পু ভাই; সঙ্গীত পরিচালনায় সাইদুজ্জামান সুমন ও সোহান যাযাবর। কথা সুর ও সঙ্গীত করেছেন সোহান যাযাবর অ মিন্টু। আর্ট ডিরেক্টশন দিয়েছেন আহমেদ সালেকিন, স্থিরচিত্র গ্রহণ করেছেন মোঃ সুলতান মিয়া। সহকারী পরিচালক হিসেবে আছেন মো সাজ্জাদুল ইসলাম খান ও রাকিবুল হাসান। দ্য টাইমস মিডিয়া লি: নিবেদিত, ‘জলছবি ফিল্মস ও আদ্রেইন ফিল্মস এন্টারটেইনমেন্ট’ পরিবেশিত এর চলচ্চিত্র ‘দ্য ক্লে’ প্রযোজনা করেছেন আলী জুলফিকার জাহেদি ও এমএইচএম মুবাশশির। ইতিমধ্যে চলচ্চিত্রটি একাধিক পুরষ্কারসহ ইউএসএ, কানাডা, ইতালি, স্পেন, ভারত, চীন, নাইজেরিয়া এবং ইউকেসহ পৃথিবীর প্রায় ৩০টির অধিক ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়েছে।

বর্তমান ব্যস্ততায়
সম্প্রতি মুবাশশির তার নতুন শর্টফিল্ম ‘পাসপোর্ট’ এর শুটিং শেষ করেছেন। গল্প সম্পর্কে মুবাশশির বলেন, এই শর্টফিল্মে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত একজন অবৈধ শ্রমিকের জীবনগল্পের একটা দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। শর্টফিল্ম ‘পাসপোর্ট’ এর এখন পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ চলছে। চলচ্চিত্রকে সমাজ সংশোধনের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে দেখেন তরুণ এ চলচ্চিত্র নির্মাতা। ‘চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সমাজের পরিবর্তন সাধন’ এ শ্লোগানকে সামনে নিয়ে মুবাশশির তাদের প্রতিষ্ঠান ‘জলছবি ফিল্মস’ এর মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদান রাখার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন। এছাড়াও মুবাশশির অনলাইন বেইজড এডুকেশন নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন। এমএইচএম মুবাশশির বলেন, আমার আকাশটা অনেক বড়। এই রঙিন আকাশটা সবাইকে দেখাতে চাই। আমি ক্যামেরার লেন্সে যা দেখি, তা যদি সবাইকে দেখাতে পারি, তাহলে আমার জীবন সার্থক।’