রবীন্দ্রনাথ প্রাণে জাগিয়েছেন সুর আর শুভচেতনা

রচনায় তিনি রেখে গেছেন স্বপ্ন-কল্পনা-প্রেম। প্রাণে দিয়ে গেছেন সুর ও আলোর স্পর্শ আর শুভচেতনা। তার গান গেয়ে শিল্পী সেই স্বপ্ন, সেই সুর, সেই শুভচেতনার বাণী পৌঁছে দিতে চাইলেন দর্শক-শ্রোতার হূদয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবসে তার গান, কবিতাকে অবলম্বন করে দুঃসময়কে সম্মিলিতভাবে অতিক্রম করার আহ্বান জানালেন শিল্পীরা। আহ্বান জানালেন পৃথিবী থেকে হিংসা দূর করে সবার প্রাণে মনুষ্যত্বের বাণী পৌঁছে দেয়ার। মঞ্চে মঞ্চে উগ্রপন্থার অন্ধকারের বিরুদ্ধে রবির সৃজন আলোর প্রেরণায় জীবনের জয়গান গাইবার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন শিল্পী, সাহিত্যিকগণ।

গতকাল ছিল রবিবার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস, বাইশে শ্রাবণ। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৭৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গানে, কবিতা ও আলোচনায় তাকে স্মরণ করলো বিভিন্ন সংগঠন। তার অমর সাহিত্য, সঙ্গীতের নানা পরিবেশনার মধ্য দিয়ে এই মনীষীর কীর্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানালো সবাই।

বাংলা একাডেমি

বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, প্রকৃতির প্রতি রবীন্দ্রনাথের যে ব্যাকুলতা ছিল তা পূর্ববঙ্গে এসে পূর্ণতা পায়। আর তার স্থাপত্যিক বিকাশ তিনি ঘটান শান্তিনিকেতনে। সেখানকার গৃহনির্মাণকলা থেকে শুরু করে শিক্ষা-পরিসর পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় লগ্নতার সাধনা করেছেন।

গতকাল বাংলা একাডেমিতে রবীন্দ্র প্রয়াণ দিবসের আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন। রবিবার বিকেলে একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৭৬তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষজ্ঞ বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ‘পরিবেশ, নির্মাণসংস্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক বক্তৃতা প্রদান করেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট স্থপতি, রবীন্দ্র গবেষক ও পরিবেশবিদ অরুণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাকে দৃশ্যভাষায় সহায়তা করেন সুদেষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রদান করেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ ইব্রাহীম হোসেন খান। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ প্রদান করেন একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান।

অরুণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, শুধু প্রযুক্তি দিয়ে যে স্থাপত্যের মুক্তি ঘটবে না বরং সাহিত্য-সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগের মধ্য দিয়েই যে স্থাপত্যের পূর্ণতা সম্ভব তা রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। বিশ্বপরিবেশ নিয়ে তাঁর ভাবনা ছিল নিগূঢ় এবং তা তিনি বিশদ করে লাভ করেছেন পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ, পতিসর, শাহজাদপুরে বসবাসের সূত্রে। বস্তুত পূর্ববঙ্গের শিলাইদহই ছিল শান্তিনিকেতনের প্রাককথন। আলো-বাতাস ও পরিসরকে রবীন্দ্রনাথ স্থাপত্যের আত্মা মনে করতেন। তিনি বলেন, যে কোনো নির্মাণকে সৃষ্টিমুখী করে গড়ে তুলতে হবে- এই ছিল রবীন্দ্রবিশ্বাস। স্থাপত্য তাঁর কাছে ছিল আকারের মহাযাত্রা। আমরা আজ উদগ্রতাকে এবং বিশালতাকে স্থাপত্যের গুণ হিসেবে জ্ঞান করছি কিন্তু রবীন্দ্রচিন্তার আলোকে স্থাপত্যকে যদি আমাদের মানবীয় ভাবনার অংশী করে তুলতে পারি তবে দেখব স্থাপত্যের ভেতর প্রকৃতির স্পন্দন জাগানোতেই এর মহিমা নিহিত।

মোঃ ইব্রাহীম হোসেন খান বলেন, বাঙালি জীবনের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি শান্তি ও সম্প্রীতির, সৃষ্টি ও কল্যাণের ভাবনা ভেবেছেন সবসময়। তাঁর স্থাপত্যচিন্তাতেও খুঁজে পাওয়া যায় কালোত্তীর্ণ মানবভাবনা।

শামসুজ্জামান খান বলেন, বাংলা একাডেমি এবার ভিন্ন আঙ্গিকে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করছে। তাঁর সাহিত্যকর্মের মতোই স্থাপত্যচিন্তাও ব্যতিক্রমী এবং মৃত্তিকালগ্ন যা আজকের দিনেও আমাদের জন্য সমান প্রাসঙ্গিক।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে একক রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট শিল্পী কাদেরী কিবরিয়া। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন- দেবু চৌধুরী (তবলা), রিচার্ড কিশোর (গীটার) এবং নাজমুল আলম খান (মন্দিরা)।

ছায়ানট

রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে ছায়ানট স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় ছায়ানট ভবনের প্রধান মিলনায়তন দর্শক-শ্রোতায় পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ‘বাজাও তুমি কবি’ সম্মেলক কণ্ঠে এ গানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ছায়ানটের আয়োজন। সম্মেলক কণ্ঠে গাওয়া অন্য গানগুলি ছিল ‘বাদল-বাউল বাজায় রে’, ‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে’ ও ‘শ্রাবণের গগনের গায়’। জহিরুল হক খান ও শামীমা নাজনীনের ‘কর্ণ কুন্তী সংবাদ’ কবিতার আবৃত্তি মুগ্ধতা ছড়িয়েছে মিলনায়তনে। এছাড়াও আবৃত্তি করেন এটিএম জাহাঙ্গীর। একক কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনান লাইসা আহমেদ লিসা ‘অশ্রু ভরা বেদনা’, মোস্তাফিজুর রহমান তুর্য ‘এসো গো জ্বালিয়ে দিয়ে যাও’, ফারজানা আক্তার পপি ‘এসেছিলে তবু আস নাই’, সেজুঁতি বড়ুয়া ‘দিনের বেলায় বাঁশি তোমার’, ইফফাত আরা দেওয়ান ‘শ্রাবণের ধারার মত’, আব্দুল ওয়াদুদ ‘শ্যামল ছায়া নাইবা পেলে’, সেমন্ত্রী মঞ্জরী ‘এই শ্রাবণের বুকের ভিতর’, সুকান্ত চক্রবর্তী ‘যে রাতে মোর দুয়ার গুলি’, সুতপা সাহা ‘আমার দিন ফুরালো’ ও নাঈমা ইসলাম নাজ ‘রাত্রি এসে যেথায় মেশে’। সবশেষে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান।

শিল্পকলা একাডেমি

কবির প্রয়াণ দিবসের ‘রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক আলোচনা ও সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। গানের সুরে, কবিতার শিল্পিত উচ্চারণে কিংবা বক্তার আলোচনায় শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে বিশ্বকবিকে। একাডেমির সঙ্গীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন শিক্ষাবিদ, গবেষক ও লেখক ড. হায়াত্ মামুদ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মাসকুর-এ-সাত্তার কল্লোল।

আলোচনা শেষে ছিল সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। একাডেমির শিশু শিল্পীদের সম্মেলক গানে শুরু হয় অনুষ্ঠান। শিশুরা গেয়ে শোনান, তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে, এ আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে। শিশুদলের পরিবেশিত পরের গানের শিরোনাম ছিল ‘আকাশভরা সূর্য তারা’। একক কণ্ঠে অনিমা রায় গেয়ে শোনান ‘ ছি ছি চোখের জলে ভেজাসনে আর মাটি’ ও ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান’, কমলিকা চক্রবর্তী শোনান ‘তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে’ ও ‘আমার সকল দুঃখের প্রদীপ’। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষার্থীরা পরপর পরিবেশন করে তিনটি রবীন্দ্রসঙ্গীত। গানগুলো হলো— ‘ঐ মহামানব আসে’, ‘শুভ কর্মপথে নির্ভয়ে গান’ ও ‘আনন্দ ধ্বনি জাগাও গগনে’। সুরের মাঝে কবিতার শব্দধ্বনি। আবৃত্তিশিল্পী মাহমুদা আক্তার পাঠ করেন ‘নিষ্ফল কামনা’ শিরোনামের কবিতা। নুসরাত বিনতে নূর গানে সুরে বলে যান রূপময় ঋতু বর্ষার কথা। গেয়ে শোনান ‘শ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে’। সাজেদ আকবর পরিবেশিত গানের শিরোনাম ছিল ‘সঘন গহন রাতি’। সরকারি সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিল্পীদের সম্মেলক কণ্ঠে গীত হয় ‘সুরের গুরু দাও গো সুরের দীক্ষা’। সৈয়দ হাসান ইমামের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ‘বোঝাপড়া’ ও ‘দুঃসময়’ শিরোনামের কবিতা। এছাড়াও রবীন্দ্র রচনা থেকে আবৃত্তি করেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ও কৃষ্টি হেফাজ। মহিউজ্জামান চৌধুরী ময়না পরিবেশিত গানের শিরোনাম ছিল ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ ও ‘তুমি কি কেবলই ছবি’। সুললিত কণ্ঠে শামা রহমান গেয়ে শোনান ‘বন্ধু রহো রহো সাথে’। একইসঙ্গে স্বদেশ ও কবিগুরুর প্রতি ভালোবাসা নিবেদন করে মামুন জাহিদ খান পরিবেশন করে ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’ ও ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’ শীর্ষক দুটি গান। জলি রহমানের কণ্ঠে গীত হয় রূপ ‘সাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ রতন আশা করে’। রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদের শিল্পীদের সম্মেলক গানের সুরে শেষ হয় রবীন্দ্র প্রয়াণবার্ষিকীর এ আয়োজন।