ছিটমহল বিনিময়ের দুই বছর পূর্তি আজ। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করবে নতুন বাংলাদেশিরা। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে (১ আগস্ট শূন্য প্রহরে) বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে ৬৮ বছরের বঞ্চনার। স্থল সীমান্ত চুক্তি (মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি) বাস্তবায়নের মাত্র দুই বছরের মধ্যে পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে এসেছে আমূল পরিবর্তন। লালমনিরহাট, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রাম প্রতিনিধির খবর-
লালমনিরহাট: গতকাল সোমবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে মোমবাতি প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে দিনটি শুরু করবে বিলুপ্ত ছিটমহলের নতুন বাংলাদেশিরা। মঙ্গলবার সকালে বাংলাদেশের জাতীয় খেলা হা-ডু-ডু, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা ও বিভিন্ন রকম শিশুতোষ খেলাধুলা দিয়ে সারাদিন আনন্দ করবে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী। পশ্চিম আকাশে সূর্যের আলো নিভে যাওয়ার আগেই লাঠি খেলা দিয়ে শেষ করবে সারাদিনের কর্মসূচি। সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত চলবে পালাগান, সারিগান, যাত্রাপালা ও বিভিন্ন নাচ-গান। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্য রাতে ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে দীর্ঘ ৬৮ বছরের বন্দি জীবনের মুক্তি মিলে ভারত-বাংলাদেশের ১৬২টি ছিটমহলের কয়েক হাজার মানুষের। যার মধ্যে ১১১টি বাংলাদেশের এবং বাকি ৫১টি ভারতের ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়। এগুলোর মধ্যে কুড়িগ্রাম জেলায় ১২টি, লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি, পঞ্চগড় জেলায় ৩৬টি ও নীলফামারীতে রয়েছে ৪টি।
এ বিষয়ে বিলুপ্ত বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির লালমনিরহাট জেলার সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইসলাম আশিক জানান, প্রতিটি ছিটমহলে বিজয় উৎসব পালন করা হবে। এ ছাড়া প্রতিটি ছিটমহলে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করা হয়েছে। এর পাশাপাশি নাচ, জারিগান, যাত্রাপালা ও লাঠি খেলা হবে। তিনি আরো জানান, মাত্র ২ বছরে আমাদের ভাগ্যোন্নয়নে সরকারের যে আন্তরিকতা দেখেছি তাতে আমরা কৃতজ্ঞ। ইতিমধ্যে আমরা বিদ্যুৎ, পাকা রাস্তা, নলকূপ, পায়খানা, ক্লিনিকসহ বিভিন্ন সরকারি সুবিধা পেয়েছি। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সারা জীবন মনে রাখবে বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষ।
স্থানীয় এমপি মোতাহার হোসেন জানান, প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেখভাল করছেন। ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ, রাস্তা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এখন বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির কাজ চলছে।
পঞ্চগড়: বিলুপ্ত ছিটমহলগুলো বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় বদলে গেছে এ দেশের মানচিত্র। সেই সঙ্গে বদলে গেছে ছিটমহলের নামও। সাবেক গাড়াতি ছিটমহল এখন রাজমহল আর পুঁটিমারী ছিটমহল এখন বীরমুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম নগর। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অধিভুক্ত হওয়ার মাত্র দুই বছরের মাথায় দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ৩৬টি ছিটমহলের মানুষের জীবনে। নাগরিকত্ব ও মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রাস্তাঘাট এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো উন্নয়নসহ সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে খুশি ৬৮ বছর পিছিয়ে থাকা এই মানুষগুলো। নতুন বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে শুরু হয় সরকারের উন্নয়ন যজ্ঞ। ঘরে ঘরে জ্বলছে বিজলি বাতি, চারদিকে চলছে রাস্তা পাকাকরণের কাজ, গড়ে উঠেছে নতুন নতুন স্কুল-কলেজ, প্রতিটি পরিবার ব্যবহার করছে স্যানিটারি ল্যাটিনসহ নলকূপ, দল বেঁধে শিশুরা ছুটছে স্কুলের দিকে এমনই চিত্র এখন পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে।
পঞ্চগড় গাড়াতি ছিটমহলের জাহানার বেগম জানান, দেশ স্বাধীন করেছেন শেখ মুজিব আর ছিটমহল স্বাধীন করেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মফিজার রহমান কলেজের প্রভাষক মাহবুবুর রহমান জানান, আগে আমরা বিচার পেতাম না। এখন আমরা বিচার পাচ্ছি। প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন সবাই আমাদের সহযোগিতা করছে। আমি ছিটমহলের ছেলে হয়েও পরিচয় গোপন করে লেখাপড়া করেছি। এখন আমি বিলুপ্ত ছিটমহলের কলেজেই চাকরি করতে পারছি।
সাবেক ছিটমহল আন্দোলন নেতা ও নাগরিক অধিকার সমন্বয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মফিজার রহমান জানান, সরকার আমাদের শুধু একটি পরিচয় দিয়েছে তা নয়। গত দুই বছরে আমাদের বিলুপ্ত ছিটমহলের চিত্রটিই পাল্টে গেছে। আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিলুপ্ত ছিটমহলগুলো উন্নয়নের যারা কাজ করছেন সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদাত সম্রাট জানান, বর্তমান সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় এখন আর ছিটমহলকে চেনা যায় না। মনে হচ্ছে বাংলাদেশ অংশের চেয়ে বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোই বেশি উন্নত। পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক অমল কৃষ্ণ মণ্ডল জানান, ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর জীবনযাত্রা আমূল পরিবর্তন শুরু হয়েছে।
কুড়িগ্রাম: ছিটমহল বিনিময়ের দুই বছর পূর্তিতে বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ার ছড়ার কালিরহাট বাজারে সোমবার রাত ১২টা ১ মিনিটে মোমবাতি প্রজ্বলন ও ১ আগস্ট দিনব্যাপী খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বিলুপ্ত ছিটবাসীরা। ইতিমধ্যে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর জীবন-মান উন্নয়নে রাস্তা, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সরকারের নেয়া নানা কর্মসূচির বাস্তবায়ন শুরু হয়। প্রায় ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এলজিইডির মাধ্যমে ২২ কিলোমিটার পাকা রাস্তার কাজ প্রায় শেষ। এ ছাড়া দাসিয়ার ছড়ায় নীলকমল নদের ওপর প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হবে একটি সেতু। নির্মিত হয়েছে ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে কালিররহাটে কমিউনিটি রিসোর্স সেন্টার। ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০টি হতদরিদ্র পরিবারের বসতবাড়ি নির্মাণ ও ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ করা হয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন উপজেলা ভূমি প্রশাসন দাসিয়ার ছড়ায় ৫ শতাধিক আপত্তি নিষ্পত্তি পূর্বক ব্যক্তি মালিকানাধীন ১ হাজার ৬৪৩.৪৪ একর ও সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত ৯ একর জমির প্রাক-জরিপ শেষ করে সেটেলমেন্ট বিভাগকে পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য ন্যস্ত করেছে। প্রায় ২ হাজার ৫৬২ পরিবারে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। এখন আর কোনো বাড়িই নেই বিদ্যুৎবিহীন।