ব্যাংকে আমানতের সুদহার কম এবং পুঁজিবাজারে আস্থা ফিরে না আসায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বিদায়ী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ৫২ হাজার ৪১৭ কোটি টাকার নিট ঋণ এসেছে সরকারের। এর মধ্যে শুধু জুন মাসেই এসেছে ৫ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা। এর আগে একক কোনো মাসে এই পরিমাণ নিট ঋণ আসেনি সঞ্চয়পত্র থেকে। জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের মাসিক বিনিয়োগ বিবরণী থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
মূলত নতুন অর্থবছর থেকে সঞ্চয়পত্রের কোনো কোনো স্কিমের মুনাফার হার কমিয়ে আনা হতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে গত অর্থবছরের শেষ দিকে তড়িঘড়ি করে অনেকেই বিনিয়োগ করায় গত জুনে রেকর্ড পরিমাণ বিনিয়োগ এসেছে সঞ্চয়পত্রে।
গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯ হাজার কোটি টাকা নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও বিক্রি বেশি হওয়ায় অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়। অবশেষে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার থেকেও ৭ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা বেশি ঋণ আসে সরকারের।
বিদায়ী অর্থবছরে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রে মোট জমা হয় ৭৫ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে থেকে মূল ও মুনাফা পরিশোধ করা হয় ২২ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। ফলে নিট বিনিয়োগ দাঁড়ায় ৫২ হাজার ৪১৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মূল ও মুনাফা পরিশোধের পর যে পরিমাণ অর্থ অবশিষ্ট থাকে তাকে বলা হয় নিট বিনিয়োগ।
ফলে নিট বিনিয়োগ দাঁড়ায় ৫২ হাজার ৪১৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মূল ও মুনাফা পরিশোধের পর যে পরিমাণ অর্থ অবশিষ্ট থাকে তাকে বলা হয় নিট বিনিয়োগ। বিনিয়োগের ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা প্রয়োজন অনুযায়ী বাজেটে নির্ধারিত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৮ হাজার কোটি টাকা নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও বছর শেষে নিট ঋণ দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকায়। সেই হিসাবে আগের অর্থবছরের তুলনায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৮ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা বেশি ঋণ এসেছে সরকারের।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে ব্যাংকে মেয়াদি আমানত রেখে ৫-৬ শতাংশ সুদ পাওয়া যাচ্ছে। অথচ পাঁচ বছর আগেও ১২ শতাংশের বেশি সুদ পাওয়া যেত। অন্যদিকে ব্যাংকের সুদহার কমলেও ২০১৫ সালের মে মাসে কিছুটা কমানোর পরও সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ১১ শতাংশের ওপরেই রয়েছে। যে কারণে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ দিন দিন বাড়ছে।
জানা গেছে, দেশি-বিদেশি উভয় উৎস থেকে ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটায় সরকার। অভ্যন্তরীণ উেসর মধ্যে আগে বেশি ঋণ আসত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। এখন বেশি ঋণ আসছে ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে, বিশেষ করে সঞ্চয়পত্র থেকে। অথচ ২০১২-১৩ অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র থেকে মাত্র ৭৭৩ কোটি টাকা নিট ঋণ আসায় পরবর্তী অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু পরের অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকেই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে উল্লম্ফন দেখা যায়। চলতি অর্থবছরে এই উল্লম্ফন আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে একের পর এক নতুন রেকর্ড গড়ে।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, একক মাস হিসেবে সবচেয়ে বেশি নিট ঋণ এসেছে গত জুনে। এর আগে গত জানুয়ারিতে সর্বোচ্চ নিট ঋণ এসেছিল ৫ হাজার ৪২০ কোটি টাকা।
এদিকে সঞ্চয়পত্র থেকে লক্ষ্যমাত্রার অতিরিক্ত ঋণ পাওয়ায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ খুব একটা কাজে লাগছে না। উল্টো আগের বকেয়া ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। এতে সরকারের সুদের ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে গত ২৬ জুলাই মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, জাতীয় সঞ্চয়পত্রের স্কিমগুলোর বাজার সুদহারের সঙ্গে সংগতিহীন উচ্চ মুনাফা হার সরকারের জন্য অতিরিক্ত সুদ ব্যয়ভার সৃষ্টি ছাড়াও মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বন্ড বাজারের বিকাশ বিশেষভাবে বাধাগ্রস্ত করছে; এর ফলে মুদ্রানীতির কার্যকারিতার জন্য দরকারি সুষ্ঠু ‘ট্রান্সমিশন চ্যানেল’ বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ আসছে পরিবার সঞ্চয়পত্র থেকে। এই খাত থেকে বিদায়ী অর্থবছরে নিট ঋণ এসেছে ২০ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা। তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ঋণ এসেছে ১৪ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে নিট ৫ হাজার ৩১ কোটি টাকা এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ৪ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা নিট ঋণ এসেছে।
জানা গেছে, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের লাগাম টানতে এসংক্রান্ত নীতিমালা আরো কঠোর করার কাজ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরও এ নিয়ে তাদের মতামত পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়ের কাছে।
সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোর বিষয়ে বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশেই বয়স্ক নাগরিকসহ বিভিন্ন শ্রেণির নাগরিকদের এ ধরনের সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া হয়। তাই আমাদের দেশেও পরিবার এবং পেনশনারদের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ওপর দেওয়া সুদহার না কমানোই সমীচীন হবে। তবে যে কেউ যেন এতে বিনিয়োগ করতে না পারে সেটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে সঞ্চয়পত্র থেকে আসা ঋণ অপব্যয় হচ্ছে কি না সেটাও দেখভাল করতে হবে। ’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বেশি থাকায় স্বল্প আয়ের লোকজন ও অবসরে যাওয়া বৃদ্ধরা এক ধরনের সামাজিক সুরক্ষা পাচ্ছে। সেই দিক থেকে সুদব্যয় বাড়লেও এটা অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে এখানে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের সীমা সঠিকভাবে পরিপালন হচ্ছে কি না সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছর সঞ্চয়পত্র থেকে ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা এবং ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের।