এক ঘণ্টায় সাড়ে ৪ লাখ

সকাল থেকে কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি, কখনো বা মুষলধারায় বৃষ্টি। এক কথায় বলা যায়, চরম বৈরী আবহাওয়া। এরই মাঝে রাস্তায় নেমে এসেছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ লাখো নারী-পুরুষ। কারো হাতে শাবল-কোদাল, কারো হাতে ছাতা, কেউ ডিজিটাল ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে হাজির। কেউ এসেছে ব্যান্ড বাদ্যদল নিয়ে। প্রকৃতির প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে সকাল থেকে রাস্তার ধারে, প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণে, ঝোপের পাশে তারা দাঁড়িয়ে। হাতে হাতে নানা প্রজাতির ফলদ বৃক্ষের চারা। সকাল ১১টা বাজতেই শুরু হলো চারা রোপণ। আগে থেকেই খুঁড়ে রাখা গর্তে চলতে থাকে বৃক্ষরোপণ।

চট্টগ্রামের রাউজানে ঈদের আমেজে বৃক্ষরোপণের এই চিত্র দেখা গেছে গতকাল মঙ্গলবার। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে মাত্র এক ঘণ্টায় সাড়ে চার লাখ ফলদ চারা রোপণ করা হলো এই উপজেলায়। এর মধ্য দিয়ে এক অনন্য রেকর্ডের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হলো বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেন ও মহাকবি নবীন সেনের জন্মস্থান রাউজান। উপজেলাকে গ্রিন সিটিতে রূপান্তর, ফল ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এই অনন্য উদ্যোগ। স্থানীয় সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর চার মাস আগে থেকে নেওয়া এই পদক্ষেপ গতকাল বাস্তবে রূপ লাভ করল।

প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে সাড়ে চার লাখ চারা রোপণের এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের সহযোগিতায় ছিল উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা কৃষি বিভাগ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম হোসেন রেজা এ ব্যাপারে বলেন, ‘দীর্ঘ চার মাসের প্রস্তুতি শেষে ১৫৩টি বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে বৃক্ষরোপণের এই মহোৎসব সম্পন্ন হয়েছে। উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে ৮০ হাজার শিক্ষার্থী, কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনীতিক, সামাজিক সংগঠন, স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষকসহ প্রায় দুই লাখ মানুষ এই কর্মসূচিতে অংশ নেয়। ব্যবসায়ীরা সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত দোকান বন্ধ রেখে এই কর্মসূচিতে অংশ নেয়। ’ তিনি জানান, কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া একেকজন এক থেকে পাঁচটি পর্যন্ত চারা রোপণ করে। এগুলোর মধ্যে ২০ প্রজাতির দেশীয় ফলের চারা রয়েছে। রংপুর, রাজশাহী, বান্দরবান, লামা, হাটহাজারী, কাউখালী, এলাকার তিনটি সরকারি ও তিনটি বেসরকারি নার্সারি থেকে চারাগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে।

এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি ভিজিল্যান্স টিম ও উপজেলার ম্যাজিস্ট্রেটসহ ৩৫টি টিম বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে। তাদের মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবসহ চার কর্মকর্তা ছিলেন। ফজলে করিম এমপি নিজেই রাউজান কলেজ, গহিরাসহ বিভিন্ন স্পটে নিজ হাতে চারা লাগান এবং উপজেলার ওপর দিয়ে বিস্তৃত চট্টগ্রাম-রাঙামাটি-কাপ্তাই সড়কসহ গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে এ কার্যক্রম ঘুরে দেখেন। কর্মসূচি শেষে উপজেলা সদর, বিভিন্ন ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে আনন্দ মিছিল বের করা হয়।

শিক্ষার্থী, শিশু ও নারীদের অংশগ্রহণ : সাড়ে চার লাখ ফলদ চারা লাগানোর অংশীদার হলো শিক্ষার্থী, শিশু এবং নারীরাও। উপজেলার ১৩ কলেজ, ১০ মাদরাসা, দুই শতাধিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্কাউট, গার্ল গাইডসহ ৮০ হাজার শিক্ষার্থী এই কার্যক্রমে অংশ নেয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেন উপজেলা শিক্ষা অফিসার চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার সাইফুল ইসলাম।

গৃহবধূ এমনকি ৬০-৭০ বছর বয়সের নারীরাও ছিলেন এ কার্যক্রমে। রাউজান-নোয়াপাড়া সেকশান-২ সড়কে শত শত নারীকে দেখা গেছে চারা রোপণ করতে। এমনই কয়েকজন সাহেদা বেগম (৬৫), আয়েশা খাতুন (৬৫) ও জয়নাব বেগম (৫০)। তাঁদের সবার বাড়ি পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নে। তাঁরা বলেন, ‘জীবনে অনেক সময়ই বৃক্ষ রোপণ করেছি। তবে এ রকম একসঙ্গে বৃক্ষরোপণের আনন্দই আলাদা। গাছের চারা লাগিয়ে এমন আনন্দ আর কখনো পাইনি। ’

বাগোয়ান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভূপেশ বড়ুয়া বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে ২৩ হাজার চারা রোপণ করা হয়েছে। এখানে শিক্ষার্থীসহ ১৪ হাজার নারী-পুরুষ এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে। ’

বৃক্ষরোপণে হাতেখড়ি : গশ্চি উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে নাজমিন আকতার, সোনিয়া ও ইয়াছিম আকতার। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে ফাতেমা জসিম পুষ্পা। আবার মীরধারপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আকতার, বর্ষা, সাইমা আকতার, আসিফ, তানভীর আলম, মেহেবুব ও নুশরাত জাহান। ওরা জীবনে প্রথমবারের মতো গাছের চারা রোপণ করেছে গতকাল। স্বাভাবিকভাবেই ওদের অনুভূতিটাও একটু বেশি আবেগের—‘এটি খুবই আনন্দের ব্যাপার। এটি যদি কোনো রেকর্ড হয়, সে আনন্দের ভাগিদার আমরাও হবো। ’

গিনেস বুকে নাম লেখাতে চায় রাউজান : সাড়ে চার লাখ ফলদ গাছের চারা রোপণের এই অনন্য উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে গিনেস বুকে নাম উঠাতে চায় রাউজান প্রশাসন। এ জন্য প্রশাসনের তরফ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন ‘এটি অবশ্যই একটি মাইলফলক। রাউজানের আগে কোনো উপজেলা একসঙ্গে এক ঘণ্টায় এত বেশি চারা রোপণ করেনি। ভুটান আড়াই লাখ চারা রোপণ করে গিনেস বুকে নাম লিখিয়েছে। এখন পর্যন্ত সেটিই রেকর্ড। দেশের মধ্যে তারাগঞ্জ উপজেলা গত বছর এক ঘণ্টায় আড়াই লাখ চারা রোপণ করেছিল। আমি গিনেস বুক বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা মিডিয়ার রিপোর্ট, ভিডিও চিত্র, এক হাজার স্পটের ছবিসহ নানা তথ্য-উপাত্ত চেয়েছে। তা ছাড়া তারা নিজেরাও তথ্য সংগ্রহের কথা বলেছে। রাউজানের এই উদ্যোগ গিনেস বুক রেকর্ডে উঠে আসার ঘোষণাটা এ বছরই আসবে বলে আশা করছি। ’

ফজলে করিম এমপির সংবাদ সম্মেলন : বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি শেষে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে সংবাদ সম্মেলন করেছেন এই কর্মসূচির উদ্যোক্তা ফজলে করিম এমপি। উপজেলার নোয়াপাড়ায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘এক ঘণ্টায় সাড়ে চার লাখ ফলদ চারা রোপণ করে রাউজান বিশ্বরেকর্ড গড়ল। সব মানুষ এককাতারে এসে এই উদ্যোগ সফল করেছে। আমরা রাউজানকে পিংক সিটি করেছি। আগামী দিনে গ্রিন ও ক্লিন সিটি গড়ার চেষ্টা করছি। ’

এ ছাড়া বিকেলে উপজেলা কমপ্লেক্সে প্রেস ব্রিফিং করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম হোসেন রেজা। এ সময় উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জুনায়েদ কবির সোহাগ, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম, প্রকল্প কর্মকর্তা নিয়াজ মোর্শেদসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

পবিবেশবাদী সংগঠনের বক্তব্য : রাউজানে সাড়ে চার লাখ ফলদ বৃক্ষের চারা রোপণের খবরটি কালের কণ্ঠে প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জেনেছিলেন সিরাজগঞ্জের পরিবেশবাদী সংগঠন ‘স্বাধীন জীবন’র নির্বাহী পরিচালক আবদুর রাজ্জাক নাছিম। এ প্রসঙ্গে গতকাল তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন ‘রাউজানের মানুষের এই উদ্যোগ অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করবে। তবে সরকারিভাবে প্রচুর গাছ রোপণ ও গিনেস বুকে নাম তোলাটা বড় কথা নয়। রোপিত গাছগুলো বাঁচাতে হবে। তবেই এ চেষ্টা সার্থক হবে। ’