বড় হচ্ছে বগুড়ার মুদ্রণ শিল্প যুক্ত আছে ১০ হাজার শ্রমিকবড় হচ্ছে বগুড়ার মুদ্রণ শিল্প যুক্ত আছে ১০ হাজার শ্রমিক
একসময় স্কুল-কলেজের বিভিন্ন সহায়ক বই প্রকাশ করে বগুড়ার প্রকাশনী ও মুদ্রণ মালিকরা উত্তরবঙ্গে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। কিন্তু ঢাকাকেন্দ্রিক প্রকাশনীগুলোর চাপে বগুড়ার পুরনো প্রকাশনীগুলো এখন কোণঠাসা। বাজারে টিকতে সৃজনশীল প্রকাশনার দিকে ঝুঁকছে তারা। তবে এর মধ্যেই বড় হচ্ছে মুদ্রণ শিল্প। প্রকাশকরাও নতুন নতুন কৌশলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হচ্ছে।
ঠিক কবে বগুড়ায় মুদ্রণ শিল্পের শুরু হয়েছিল, তার সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। প্রবীণদের ধারণামতে, ১৯০০ সালের পর বগুড়া মুদ্রণ শিল্পের ছোঁয়া পায়। অনেকে বলেন, ১৯৩০ সালের পর বগুড়ায় দু-একটি ছাপাখানা দিয়ে মুদ্রণ শিল্পের শুরু হয়। এ ছাপাখানা পঞ্চাশের দশকে চার থেকে পাঁচটিতে গিয়ে দাঁড়ায়। এর পর ষাটের দশকে সাত থেকে আটটি। ষাটের দশকে টাউন প্রেস, লিথোগ্রাফি প্রেস, ওরিয়েন্ট প্রেস, সার্ভিস প্রিন্টিং প্রেসের নাম পাওয়া যায়। ষাট থেকে সত্তরের দশকে বগুড়ায় শিশুশিক্ষা, শিশুদের প্রথম পাঠ, শিশুদের মজার পাঠ, বিভিন্ন শ্রেণীর সহায়ক বইয়ের পাশাপাশি সাহিত্য ও সৃজনশীল বই প্রকাশ হতো। স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘দস্যু বনহুর’খ্যাত লেখিকা রোমেনা আফাজের প্রথম দিকের কিছু গল্পের বই প্রকাশ হতো বগুড়ার সাহিত্য কুটির নামের প্রকাশনী সংস্থা থেকে।
এভাবেই বড় হয়েছে বগুড়ার মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্প। এখন ছোট-বড় মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক প্রেস বসেছে। দু-তিনটির স্থলে এখন ২০টির বেশি প্রকাশনী রয়েছে। বগুড়া শহরের বাঁদুরতলা, চকসূত্রাপুর, শাপলা সুপার মার্কেট ঘিরে সবচেয়ে বেশি ছাপাখানা গড়ে উঠেছে। বাঁদুরতলার একটি এলাকা তো এখন ‘প্রেসপট্টি’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।
মুদ্রণ শিল্প মালিক সমিতি ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মালিক সমিতির কাগজে-কলমে ২৭০টি প্রেস রয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আরো ২০০টি। প্রতিটি প্রেসই সচল। প্রেসগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন বাইন্ডিং, কম্পিউটার, কাগজ, কালি, প্লেট সেকশনের শ্রমিকরা। এসব মিলিয়ে বগুড়ায় প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। প্রেসগুলোয় বিভিন্ন শ্রেণীর সহায়ক বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জন্য নানা বিষয়ে ছাপারও কাজ হয়ে থাকে। কখনো কখনো ঢাকা থেকেও বই ছাপানোর অর্ডার নেয়া হয়।
বগুড়ায় এখন কিন্ডারগার্টেন, স্কুল ও কলেজ শাখার মডেল প্রশ্নমালা, গাইড, বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণ, ভূগোল গাইড প্রকাশ করা হচ্ছে। ২০টি প্রকাশনা থেকে কমপক্ষে অর্ধশত বই বিভিন্ন প্রকাশনীর নামে বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। বগুড়ার নামি প্রকাশনীর মধ্যে রয়েছে কিশোর লাইব্রেরি, সাহিত্য সোপান, সাহিত্য কুটির, বাংলাদেশ লাইব্রেরি, চয়েস প্রকাশনী, জিনিয়াস প্রকাশনী, বনানী প্রকাশনী, নিউজ কর্নার পাবলিশিং, আলো লাইব্রেরি, প্রজাপতি প্রকাশনী, সূচনা প্রিন্টিং ও প্রকাশনী।
সাহিত্য সোপানের পরিচালক শুভ ইসলাম জানান, স্বাধীনতার আগে তার নানা বগুড়ায় সাহিত্য কুটির পরিচালনা করতেন। ১৯৫৪ সালে যাত্রা শুরু করে পরিচালকের মৃত্যুর পর ১৯৯১ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়। প্রকাশনী হিসেবে সাহিত্য সোপানের যাত্রা শুরু ১৯৯২ সালে। এখান থেকে এইচএসসি, ডিগ্রি, অনার্স, মাস্টার্সের ভূগোল গাইড প্রকাশন করা হয়। অন্যান্য বইয়ের পাশাপাশি সাহিত্য সোপান এখন সৃজনশীল বই প্রকাশ করছে বেশি। শিক্ষাক্রমে পরিবর্তনের কারণে তাদের সৃজনশীল বই প্রকাশে ঝুঁকতে হচ্ছে বলে জানান শুভ ইসলাম।
ব্যবসা ধরে রাখতে গাইড ও সহায়ক বই প্রকাশ একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে নিউজ কর্নার পাবলিশিং। এর পরিচালক কালিপদ সেন টিপু জানান, এ পর্যন্ত প্রায় ২০০টি সৃজনশীল বই প্রকাশ করেছেন তিনি।
বগুড়া জেলা পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা জানান, জেলায় চার শতাধিক সদস্য রয়েছেন। প্রকাশক বা প্রকাশনা রয়েছে ২০টির মতো। প্রকাশনী থেকে এখন বিভিন্ন নামের গ্রামার বই প্রকাশ করা হয়। পাশাপাশি মডেল কোশ্চেন প্রকাশ পায়। স্কুলের কিছু সহায়ক বইও রয়েছে।
তবে স্কুলের মডেল গাইড বইগুলোর বাজারে এখন ঢাকার প্রকাশনীরা প্রবেশ করেছে। তারা কিছু নামি শিক্ষক ও বিক্রেতাকে বিশেষ উপঢৌকন দিয়ে গাইড বইগুলো চালিয়ে নিচ্ছে। এ কারণে বগুড়ার প্রকাশকরা পিছিয়ে পড়ছে বলে জানান রেজাউল করিম।
বগুড়া জেলা পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সাধারণ সম্পাদক নজমুল হক সোহেল জানান, মুদ্রণ শিল্পে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। বগুড়ার নাম করা প্রকাশনী থাকার পরও ঢাকার কিছু প্রতিষ্ঠান আর্থিক সুবিধা দিয়ে তাদের প্রকাশনাগুলো চালিয়ে নিচ্ছে। বগুড়ার প্রকাশনাগুলো সে সুযোগ দিতে পারছে না বলে বই চালাতে এখন হিমশিম খাচ্ছে। তিনি জানান, বগুড়ার বেশির ভাগ প্রকাশনী এখন গ্রামার বই প্রকাশ করছে।
তবে ঢাকার প্রকাশকদের কারণে বগুড়ার প্রকাশকরা পিছিয়ে পড়লেও বগুড়ার মুদ্রণ শিল্পের বেশ প্রসার হয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। তারা জানান, এ শিল্পে এখন প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক জড়িয়ে আছেন। বগুড়ার মুদ্রণ শিল্পকে আধুনিকায়ন করতে বর্তমান জায়গা থেকে সরিয়ে শহরের রেলস্টেশন রোডে স্থানান্তর করা হচ্ছে। সেখানে ৫০০ দোকান বরাদ্দ দেয়া হবে। সেখানে শুধু প্রকাশনার যাবতীয় কাজগুলো করা হবে। কিছুদিনের মধ্যে এ স্থানান্তর করা হবে।
বগুড়া মুদ্রণ মালিক সমিতির সভাপতি মাহাবুবর রহমান জানান, বগুড়ায় ছাপাখানার কাজ করতে উত্তরের ১৬ জেলা থেকে লোকজন আসে। এছাড়া ঢাকার কিছু প্রকাশনী শুধু কম্পিউটারের কাজ করার পর বাকিটা বগুড়া থেকে কাজ করে নিয়ে যায়। বগুড়ার মুদ্রণ মালিক সমিতির সদস্য রয়েছেন ২৭০ জন। এ সমিতির বাইরেও রয়েছে প্রায় ২০০টি প্রতিষ্ঠান।