নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার প্রভাকরদী এলাকার ইসহাক পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিলেন। তাই বাবা খালেক মিয়া স্বপ্ন দেখতেন ছেলে পড়াশোনা শেষ করে বড় কোনো চাকরি করবে। সেই উদ্দেশ্য সামনে রেখে এগোচ্ছিলেন তিনি। ঢাকা আলিয়া মাদরাসা থেকে কামিলও পাস করেন ইসহাক। তবে হাড়ে মার্বেল রোগে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ তার দুই পা-ই ভেঙে পড়ে। অনেক চিকিৎসা করেও কোনো লাভ হয়নি। আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো পায়ে হাঁটা তার থেমে যায়। এখন ট্রেচারে ভর করে তাকে চলতে হচ্ছে। তবে পায়ে চলার শক্তি হারালেও, মনোবল আর প্রবল ইচ্ছাশক্তিই যেন তাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সময় নষ্ট না করে নেমে পড়েন জীবন সংগ্রামে। ট্রেচারে বসেই বাড়িতে মুরগির খামার গড়ে তুলেছেন। তিনি এখন এলাকায় আত্মনির্ভরশীলতার এক প্রতীক। খামার করে অল্প দিনের মধ্যেই স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন তিনি।
ইসহাক বলেন, আত্মবিশ্বাস, প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রম তার এগিয়ে যাওয়ার পথকে সুগম করে দিয়েছে। ২০০১ সালে মাস্টার্স পরীক্ষার দুই দিন আগে হঠাৎ তার দুই পা ভেঙে যায়। এতে করে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি তিনি। লেখাপড়া যতটুকু রপ্ত করেছেন, তা দিয়েই তিনি জীবন গড়ার কাজে নেমে পড়েন। প্রথমেই এলাকায় হাজী খালেক কিন্ডারগার্ন্টেন নামের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করেন। ২০১৪ সালে নিজের বাড়িতে গড়ে তোলেন একটি মুরগির খামার। প্রথমে ৬০০ পিস বয়লার মুরগির বাচ্চা দিয়ে খামারের যাত্রা শুরু করেন। তবে ওই বছর তার ২ লাখ টাকার মতো লোকসান যায়। বন্ধ হয়ে যায় তার খামার। ধারদেনা করে আবারও খামারে বাচ্চা ওঠান। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে তার খামারে ১৫ হাজার পিস পূর্ণবয়স্ক (কক) সোনালি মুরগি রয়েছে। তার খামারে পাঁচ যুবকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমি বারবার ধাক্কা খেয়েছি; তারপরও হত্যাশ হইনি। আশা ছিল উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বাবার স্বপন পূরণ করব। ভালো কোনো চাকরি কবর। দেশের উন্নয়নে নিজেকে বিলিয়ে দেব। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি। ১৯৯৮ সালে ঢাকা আলিয়া মাদরাসা থেকে কামিল পাস করি। একপর্যায়ে নিজের এলাকায় বাবার নামে (হাজী খালেক কিন্ডারগার্ন্টেন) একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করি। আশা ছিল, উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করব। ২০০১ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে মাস্টার্স পরীক্ষায় অংশ নেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে হাড়ে মার্বেল রোগে আক্রান্ত হয়ে দুই পায়ের হাড় ভেঙে যায়। ভেঙে যায় উচ্চতর ডিগ্রি লাভের স্বপ্নও। বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা করে কোনো লাভ হয়নি। তবে হতাশ হইনি। স্থানীয় এক পোলট্রি খামারির পরামর্শে ২০১৪ সালে বাড়িতে একটি খামার স্থাপন করি। প্রথম বছরই ব্যবসায় ২ লাখ টাকার মতো লোকসান হয়। এরপর উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। ধারদেনা করে আবারও ১ হাজার ৫০০ পিস বাচ্চা খামারে তুলি। বর্তমানে খামারে ১৫ হাজার পিস (কক) পূর্ণবয়স্ক মুরগি রয়েছে। ইসহাক এখন স্বপ্ন দেখছেন, নিজের খামারে উৎপাদিত মুরগির ডিম থেকে বাচ্চা ফোটাবেন। তিনি প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। বাচ্চা কমমূল্যে খামারিদের মাঝে বিক্রি করবেন। এতে এলাকায় নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে; বেকার সমস্যারও সমাধান হবে। ইসহাক জানান, তিনি এলাকায় প্রায় ১৩০ শতাংশের তিনটি পুকুর লিজ নিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করছেন। সেখান থেকেও তার বছরে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা আয় হচ্ছে। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে স্কুলে পড়াচ্ছেন।
আড়াইহাজার উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোঃ ফারুক বলেন, ইসহাক খামারি হিসেবে সফল। তিনি নিজের কর্মদক্ষায় এলাকায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। উৎপাদন বৃদ্ধি ও রোগবালাই দমনে আমরা তাকে সর্বদা সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি। উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মামুন মজুমদার বলেন, ইসহাক যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে খামারের পরিধি বৃদ্ধি করেছেন। তিনি এলাকায় বেকার যুবকদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। তাকে দেখে অনেকেই খামার গড়ে নিজেকে আত্মনির্ভর করে তুলছেন।