দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে লাভজনক, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থার প্রয়োজনীতা অনস্বীকার্য। সপ্তম পঞ্চবার্ষিত পরিকল্পনা ও জাতীয় কৃষিনীতিকে সামনে রেখে কৃষি খাতের সার্বিক উন্নয়নে সরকার বদ্ধপরিকর। সরকারের এ কাজে সহায়তা করছে দেশের অগণতিক পরিশ্রমী কৃষক। উভয়ের সম্মিলিত প্রয়াসে দেশ এগিয়ে যাবে সমৃদ্ধির দিকে_ এ বিশ্বাস এখন সবার।
আবু সাঈদ
সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ ও পরিকল্পনায় দেশের কৃষিতে আজ বিস্ময়কর সাফল্য অর্জিত হয়েছে। অঞ্চল ও মাটির গুণাগুণ, ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী ফসল উদ্ভাবন, লবণ, জলামগ্নতা, খরা এবং জলবায়ুসহিঞ্চু বীজ উৎপাদন, যথাযথ প্রযুক্তির প্রয়োগ কৃষিতে এ বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। গত আট বছর ধরে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ছে, ভরে উঠেছে শস্যভা-ার। এক সময়ের খাদ্য ঘাটতির দেশ শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাই অর্জন করেনি, খাদ্য রপ্তানিও করছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, গত ৮ বছরের ব্যবধানে খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৬০ লাখ টন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এজন্য যথাযথ কৃতিত্ব দিয়েছেন কৃষকদের, ফসলের মাঠে যারা নিরন্তর শ্রম দিয়েছেন। অবশ্যই এ অর্জন সম্ভব হয়েছে কৃষকের সহায়তায়, সাথে ছিল সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। শুধু মাঠে নয়, নানামুখী ইতিবাচক পদক্ষেপের কারণে কৃষির আরকটি উপ-খাত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতেও ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষকের নিরলস পরিশ্রমে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। সাফল্য আসছে ধারাবাহিক গতিতে।
সরকার ফলপ্রসূ কৃষিবান্ধব নীতি নিয়ে কাজ করছে। কৃষকের প্রয়োজনীয় উপকরণ সার, বীজ, কীটনাশক এবং কৃষি উপকরণে ভর্তুকি প্রদান, সেচের ব্যবস্থা, কৃষি কার্ড বিতরণ নিত্যনতুন উন্নত প্রযুক্তির জোগান দিয়ে যাওয়া এমন সাফল্যের পেছনে বড় নিয়ামক হয়ে উঠেছে। কৃষি উপকরণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে কৃষকেদের মধ্যে প্রায় সোয়া দুই কোটি কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড বিতরণ করা হয়েছে। ১০ টাকার বিনিময়ে কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার কার্যক্রমে কৃষকদের ঘুরে দাঁড়ানো সহজ হয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে চাল, গম, ভুট্টা উৎপাদন ছিল প্রায় ৩ কোটি ৩৩ লাখ টন, যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসে দাঁড়ায় ৩ কোটি ৯১ লাখ টনে। একইভাবে বেড়েছে ডাল, পেঁয়াজ ও পাটের উৎপাদন। উদ্ভাবিত হয়েছে নতুন জাতের বিভিন্ন ফসল।
ধারাবাহিক সাফল্যকে এগিয়ে নিতে কৃষকের সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। দেশে কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, তাই কম জমিতে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য টেকসই পদ্ধতি ব্যবহার করা প্রয়োজন। কৃষক আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি সচেতন। কোন জাত নেবে, কি প্রযুক্তি ব্যবহার করবে, কি ধরনের এবং কতটুকু সার-কীটনাশক তাদের জন্য ভালো, তা এখন তারা নিজেরাই যাচাই ও প্রয়োগ করে থাকে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল বিভিন্ন কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে কৃষির উন্নয়নে ৩৩টি গবেষণা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। গবেষণা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এ কাউন্সিল একটি রূপকল্প দলিল ২০৩০ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি টিম গঠনের মাধ্যমে সারা দেশের মাঠপর্যায়ের গবেষণা কার্যক্রম ও প্রযুক্তি হস্তান্তর কর্মসূচি পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন করছে। বিটি বেগুনের চারটি জাত উদ্ভাবন, প্রতিকূল আবহাওয়া উপযোগী করে ধান ও গমের জাত উন্নয়নসহ পরিচর্যা কলাকৌশল নির্ধারণ করে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া তাপসহিষ্ণু গমের জাত ও লবণাক্ততাসহিষ্ণু ধানের জাত দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (ইঅউঈ) ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিশেষ জাতের সুপার হাইব্রিড ধানের ৪৫৭ টন বীজ উৎপাদন ও ৬২৬.২৫ টন বোরো বীজ কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করেছে। এ ছাড়া ১৬ হাজার ৫৩৩ টন গম বীজ উৎপাদন করা হয়েছে। সেচের জন্য ৫৮০ কিলোমিটার খাল পুনর্খনন, দুটি রাবার ড্যাম নির্মাণ, ৫৫৮ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ সেচ নালা নির্মাণ, ১১ টি সৌরশক্তি চালিত সেচ পাম্প স্থাপন, ১১.২১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ, ৬১০টি শক্তিচালিত পাম্প স্থাপন, ১১৮টি গভীর নলকূপ স্থাপন, ১৪৯টি গভীর নলকূপ পুনর্বাসন করা হয়েছে।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৭টি ফসলের ৩০টি জাত অবমুক্তকরণও ২২টি ফসলের উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। দেশের গমের বস্নাস্ট রোগ শনাক্ত হয়েছে। এ রোগের বিস্তার রোধে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে গবেষণা কার্যক্রমের প্রক্রিয়া চলছে। অনুরূপভাবে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে ব্রি ধান ৭০, ৭১, ৭২, ৭৩, ৭৫, ৭৬ ও ৭৭ উদ্ভাবন এবং বোরো মৌসুমের জন্য ব্রি ধান ৭৪ উদ্ভাবন করেছে। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকার জন্য তিনটি লবণসহিষ্ণু সারির আঞ্চলিক উপযোগিতা যাচাইয়ের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। কম মাত্রার গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত ধান ব্রি ধান ৪৬ ও ব্রি ধান ৬৯ চিহ্নিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইঝজও) -এর সমন্বিত গবেষণা কার্যক্রমের আওতায় আরবীয় খেজুরগাছে জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করা হয়েছে। চরাঞ্চলে উন্নত পদ্ধতিতে ইক্ষু উৎপাদন প্রযুক্তি, গুড় তৈরি ও ব্যবহারবিষয়ক চাষি বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ইঝজও ডমেস্টিক কেন ক্রাশার যন্ত্র, সুগারবিচ রুট রট রোগ দমন প্রযুক্তি, সুগারবিট ক্যাটারপিলার পোকা দমন ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি, সুগারবিটের প্রমিতকৃত কৃষিতাত্তি্বক প্রযুক্তি, বিএসআরআই পাওয়ার উইডার যন্ত্রের সফল ব্যবহার করা হয়েছে।
মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট মাটি পরীক্ষার ভিত্তিতে সার সুপারিশমালা ২০১৬ এর আওতায় আধাবিস্তারিত মৃত্তিকা জরিপের মাধ্যমে ৪৬০টি উপজেলা ভূমি ও মৃত্তিকাসম্পদ ব্যবহার নির্দেশিকা প্রণয়ন এবং তথ্য-উপাত্ত হালনাগাদকরণের জন্য ২০টি উপজেলা ভূমি ও মৃত্তিকাসম্পদ ব্যবহার নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের উৎপাদন বাড়াতে নানামুখী পদক্ষেপের ফলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উৎপাদনেও সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে মৎস্যসম্পদ উৎপাদিত হয়েছে ৩৮ লাখ ৫৫ হাজার টন, যা এর আগের অর্থবছরে ছিল ৩৬ লাখ ৯০ হাজার টন। একই সঙ্গে আগের তুলনায় বেড়েছে মাংস, দুধ ও ডিমের উৎপাদনও। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে এক হাজার ১৯১ কোটি ২৩ লাখ ৫৬ হাজার ৭৩১টি ডিম উৎপাদিত হয়। একই সময়ে ৭২৭ কোটি ৫৭ লাখ ১৪ হাজার ৮৬ লিটার দুধ এবং ৬১ লাখ ৫২ হাজার টন মাংস উৎপাদিত হয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে লাভজনক, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থার প্রয়োজনীতা অনস্বীকার্য। সপ্তম পঞ্চবার্ষিত পরিকল্পনা ও জাতীয় কৃষিনীতিকে সামনে রেখে কৃষি খাতের সার্বিক উন্নয়নে সরকার বদ্ধপরিকর। সরকারের এ কাজে সহায়তা করছে দেশের অগণতিক পরিশ্রমী কৃষক। উভয়ের সম্মিলিত প্রয়াসে দেশ এগিয়ে যাবে সমৃদ্ধির দিকে_ এ বিশ্বাস এখন সবার।