তিন কোটি মানুষের ভাগ্যবদলের সেতু

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতুকে টপকে বিশ্বে দীর্ঘতম সেতু হিসেবে এগারোতম স্থান দখল করে নিতে যাচ্ছে আমাদের স্বপ্নের সেতু—পদ্মা সেতু। বিশ্বের উত্তাল নদীগুলোর মধ্যে পদ্মা অন্যতম একটি, অস্থির এক নদী। দুই তীরে ভাঙাগড়া চলে প্রতিবছরই। বর্ষাকালে এই নদীতে স্রোতের বেগ থাকে অনেক বেশি। পদ্মার ওপর এরকম একটি সেতু অনেকের কল্পনারও বাইরে ছিল। এর দুই তীরকে সেতুদিয়ে বাঁধতে অনেক ঝুঁকির মোকাবিলা করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কেননা পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে এক লাখ ৪০ হাজার কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হয়। আর এমন একটি নদীর ওপর সেতু নির্মাণ খুব চ্যালেঞ্জিং কাজ। পানি প্রবাহের দিক থেকে দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী পদ্মা। সুতরাং সেতু নির্মাণ এখানে এত সহজ নয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তা ও সাহসিকতার ফলে এমন স্বপ্ন আজ বাস্তবরূপ ধারণ করছে। সবচাইতে বড় কথা বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে এটি সবচেয়ে বড় প্রকল্প।

প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের দ্বিতল সেতুতে ওপরের তলায় চার লেনের সড়ক এবং নিচের তলায় ট্রেন লাইন থাকবে। আর প্রকল্প পরিকল্পনা ঠিকমতো বাস্তবায়ন হলে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ পাবে নতুন গর্বের স্থাপনা পদ্মা বহুমুখী সেতু। শ্রমিকদের ঘাম ঝরানো শ্রমে এগিয়ে চলছে পদ্মা সেতু। যতই দিন যাচ্ছে, দৃষ্টির মধ্যে ততই পুরো সেতুটি স্পষ্ট হচ্ছে।

বাণিজ্য সম্প্রসারণে পদ্মা সেতু হবে মাইলফলক। তখন গ্রামীণ অর্থনীতির উত্পাদনশীলতা হবে রপ্তানিমুখী। দারিদ্র্য নিরসন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে। গতি ও মাত্রা বাড়বে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্দেশীয় যান চলাচলের। সবমিলিয়ে সেতুর উভয়পাশে বিকাশ ঘটবে সুষম অর্থনীতির। আমাদের এই স্বপ্নের সেতু হয়ে গেলে দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি ১.২ শতাংশ বাড়বে এবং প্রতিবছর ০.৮৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য বিমোচন হবে।

আমরা যদি যমুনা সেতুর প্রভাব নিয়ে বিশ্লেষণ করি তাহলে আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে যে, বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমাঞ্চলে পাবনা ও সিরাজগঞ্জসহ অন্য জেলগুলোর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্রিজ নির্মাণের আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এতে করে সেখানকার কৃষক সহজেই কাঁচামাল ও উত্পাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারছে মসৃণভাবে। এছাড়াও শিল্প ও বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ার কারণে। দেশের অধিকাংশ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড রাজধানী থেকে পরিচালিত হয়, কিন্তু এ উন্নয়নের সুবিধাগুলো দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছাতে পদ্মা বড় একটা বাধা। এছাড়াও দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটি নৌবন্দরের একটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় অবস্থিত। এটি হলো মংলা বন্দর এবং এটার সংশ্লিষ্ট পরিবহন ব্যবস্থায় পদ্মা সেতু ব্যবহারের বিকল্প নেই। এছাড়াও পদ্মা সেতু এশিয়ান হাইওয়েতে হওয়ায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যাতায়াত ব্যবস্থার পাশাপাশি দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে যাতায়াত ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন ও সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রায় তিন কোটি মানুষের জীবনের পরিবর্তন আসবে।

পদ্মা সেতু চালু হলে সমৃদ্ধ হবে দক্ষিণের অর্থনীতি। আর এ আশা নিয়ে বড়বড় শিল্প গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এ অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ও পুঁজিপতিরা। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু ঘিরে বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র শিল্প। প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু চালু হলে মংলা বন্দরে আসবে গতিশীলতা। কুয়াকাটায় যে পায়রাবন্দর নির্মিত হচ্ছে, সেটি সচল হবে। আর সবকিছু ভালো হলে আগামীতে চট্টগ্রামের পর বরিশাল হবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র।

একথা স্বীকার করতে হবে যে, দেশের উন্নয়নে সরকার কিন্তু সুষম অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করে এগুচ্ছে। তার মধ্যে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জন্য গৌরবের ও অর্থনীতির জন্য যুগান্তকারী একটি ঘটনা। আর এটি সরকারের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। পদ্মা সেতু দেশের বৃহত্তম প্রকল্প এবং নির্মাণ পরবর্তী সময়ে এটা হবে দেশের সর্ববৃহত্ সেতু। উত্তরদিকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া উপকূল এবং দক্ষিণদিকে শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের জাজিরা উপকূল হলো সেতুটির স্থান। দেশের ওই অঞ্চল থেকে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব গড়ে ১০০ কি.মি. কমবে। এই সেতু চালু হলে মানুষ ও পণ্য পরিবহণের সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে, যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি ও আমদানি ব্যয় হ্রাস পাবে। এছাড়াও স্থানীয় জনগণ উন্নততর স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য খুব সহজেই রাজধানী ঢাকা যেতে পারবে।

বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশের মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ বা কমপক্ষে তিন কোটি মানুষ সরাসরি এই সেতুর মাধ্যমে উপকৃত হবে। আমরা আশা করি সবকিছু ভালোভাবে সম্পন্ন হবে এবং আমাদের দেশ একদিন বিশ্বে নেতৃত্ব দানে অবদান রাখবে। আর সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও নিরলস শ্রম থাকলে সেইদিন আর বেশি দূরে নেই।