বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার বাণিজ্য বছরে আট কোটি ডলারের মতো। এই বাণিজ্য বাড়াতে চলতি বছরের মধ্যেই মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার জন্য ঐকমত্য হয়েছে দুই দেশ। এই চুক্তি বাস্তবায়ন হলে শ্রীলঙ্কায় রপ্তানি বাড়বে। এতে কমবে বাণিজ্য ঘাটতিও। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের এবারের ঢাকা সফরে মধ্যে অর্থনৈতিক, বিনিয়োগ, বাণিজ্য, শিক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে ১৪ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) ও সিলন শিপিং কর্পোরেশন (সিএসসি) এবং বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই করা হয়েছে। এ দুটি বিষয়ে সমঝোতা হওয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য আরো সমৃদ্ধ হবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনার ঢাকা সফর শেষে গতকাল শনিবার দুই দেশের প্রধান নির্বাহীর এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়সহ সব ক্ষেত্রে সম্পর্ক গভীরতর করার বিষয়ে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে বলে জানানো হয়। বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের সুফল পেতে শুল্ক সহযোগিতা, দ্বৈত কর পরিহার এবং দুই দেশের মধ্যে বিনিয়োগ উন্নয়ন ও সংরক্ষণ বিষয়ে চুক্তি শিগগিরই চূড়ান্ত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দুই নেতা নির্দেশ দিয়েছেন। শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চল গড়ার প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরেন তারা। উপআঞ্চলিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রক্রিয়াগুলো গভীরতর করার বিষয়ে একমত হন তারা; বিমসটেক ও সার্কের আওতায় লক্ষ্যভেদী ও ফলাফলমুখী আঞ্চলিক সহযোগিতা স্থাপনে কাজ করার ওপর জোর দেন। সন্ত্রাসবাদ, সহিংস চরমপন্থা ও যে কোনো ধর্মীয় বা সামাজিক আবরণে উগ্রবাদীকরণ থেকে সৃষ্ট হুমকির বিষয়টি আমলে নিয়ে দুই দেশ ও এর বাইরে এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে নেতারা একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রæতি ব্যক্ত করেন। এ জন্য সহনশীলতা, অন্তর্ভুক্তি ও বহুত্ববাদ নিয়ে ২০১৮ সালে একটি ব্যাপকভিত্তিক সংলাপ অনুষ্ঠানের বিষয়ে তারা একমত হয়েছেন বলে বিবৃতিতে বলা হয়।
সূত্রমতে, বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার বছরে প্রায় ৭ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের বাণিজ্য হচ্ছে। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে শ্রীলঙ্কা থেকে ৪ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে ওই দেশে ৩ কোটি ৪ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের ঘাটতি বাণিজ্য ১ কোটি ৪৫ লাখ ৫০ হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে তা অনুকূলে আনতে হলে দেশটির বাজারে তৈরি পোশাক, কাগজ, ওষুধ, বৈদ্যুতিকসামগ্রী, পাটজাতপণ্য এবং কৃষিজাতপণ্য বিশেষ করে আলু রপ্তানি বাড়ানো প্রয়োজন। এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে দেশটিতে। যদিও চুক্তি না থাকায় শুল্ক ও অশুল্কজনিত বিভিন্ন সমস্যার কারণে শ্রীলঙ্কায় রপ্তানি বাণিজ্য তেমন বৃদ্ধি পায়নি।
তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে আসা শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনার সঙ্গে গত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এফটিএ নিয়ে ঐকমত্য হয়েছে। বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ে ১৪টি সমঝোতা স্মারকে চুক্তি সইয়ের পর দুই দেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এখন যেসব শুল্ক ও অশুল্ক বাধা রয়েছে, তা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে অপসারণ করা যাবে। চলতি বছরের সুবিধাজনক সময়ে এই চুক্তিটি করা হতে পারে। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহসভাপতি আবুল কাশেম আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, দুদেশের রাষ্ট্র প্রধানদের উপস্থিতিতে এবার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে সমঝোতা ও চুক্তি হয়েছে। এফবিসিসিআই থেকে বহু আগেই এ ধরনের চুক্তি ও সমঝোতার তাগিদ দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে অবশেষে তা হয়েছে। তিনি বলেন, বাণিজ্য ঘাটতি দূরীকরণে শ্রীলঙ্কায় ওষুধ, পাট ও পাটজাতপণ্য, কাগজ, সিরামিকের ক্ষেত্রে ডিউটি ফ্রি সুবিধা প্রদান এবং বাংলাদেশ থেকে এসব পণ্য আরো বেশি হারে আমদানি করতে হবে। এছাড়া চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার কলোম্বো এবং ট্রিনকমলির মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন প্রয়োজন। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে ফুলকপি ও আলু রপ্তানি বাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম ভোরের কাগজকে বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য এখন এক ধরনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনেক দেশকেই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্কের ওপর কিছুটা নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার বাণিজ্য বছরে আট কোটি ডলারের মতো। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হলে দুদেশের বাণিজ্য আরো বাড়বে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে প্রথমবারের মতো চুক্তি হলে বাংলাদেশে এ বিষয়ে যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে দক্ষতা বাড়াতে পারবে বলে মনে করেন তিনি।
মুক্তবাণিজ্য চুক্তির পর সার্কভুক্ত দুদেশেরই রপ্তানি বাণিজ্যের দ্বার উন্মুক্ত হবে বলে জানান বাণিজ্য সচিব শুভাশিষ বসু। তিনি বলেন, রপ্তানি বৃদ্ধিতে সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বেশকিছু দেশের সঙ্গে এফটিএ (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) ও পিটিএ (প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট) করার বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এখন শ্রীলঙ্কার সঙ্গে করা হবে, পরবর্তী সময়ে মালয়েশিয়াসহ আরো অনেক দেশের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি করা হতে পারে। তিনি বলেন, বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর বাণিজ্য উইং আরো শক্তিশালী করা হচ্ছে। কোন দেশে, কোন কোন পণ্যের চাহিদা ও বাজার রয়েছে সেসব বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে দূতাবাসগুলো। শুধু তাই নয়, প্রচলিত মার্কেটের পাশাপাশি অপ্রচলিত বা নতুন বাজারের সন্ধান করা হচ্ছে।
পোশাক শিল্প প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এফটিএ চুক্তি এর আগে কোনো দেশের সঙ্গে হয়নি। সুতরাং, এই চুক্তির ফলে এ বিষয়ে আমরা নতুন ধারণা পাব। এছাড়া শ্রীলঙ্কার অনেক টেকনিক্যাল সাপোর্ট আমরা নিতে পারব। জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, এফটিএ চুক্তি শুধু ব্যবসা বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে আমরা তেমন কোনো লাভবান হব না। সমন্বিত অর্থনৈতিক সহযোগিতা যেমন- বাণিজ্য, বিনিয়োগ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ট্যুরিজম, জলপথে সংযোগ ইত্যাদি বিষয়ে সমন্বিত চুক্তি করলে তবেই আমরা উপকৃত হব। এছাড়া শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে তাও পূরণ করা সম্ভব হবে।
অন্যান্য চুক্তির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) ও সিলন শিপিং কর্পোরেশনের (সিএসসি) মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই করা হয়েছে। গত বছরের অক্টোবর মাসে ঢাকায় সার্কভুক্ত এই দুদেশের মধ্যে উপক‚লীয় জাহাজ চালাচলে চুক্তি করতে দুদেশের নৌসচিব পর্যায়ের বৈঠকে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) চূড়ান্ত করা হয়েছিল। ওই সময় বাংলাদেশের নৌসচিব অশোক মাধব রায় এবং শ্রীলঙ্কার বন্দর ও নৌসচিব এল পি জায়ামপাথি বৈঠকে নেতৃত্ব দেন। আশোক মাধব সেই সময় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, দুদেশের রাষ্ট্র প্রধানের উপস্থিতিতে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এমওইউর পর এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেশনাল প্রসেডিউর) স্বাক্ষর হবে, দুদেশের মধ্যে কোন পদ্ধতিতে জাহাজ চলাচল করবে তা এতে থাকবে।
চুক্তির পর দুদেশের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে কার্গো জাহাজ যাতায়াত করবে, পরে চলবে যাত্রীবাহী জাহাজ। নৌমন্ত্রী শাজাহান খান এ প্রসঙ্গে ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, এ চুক্তি হলে আমরা অনেক দিক থেকে সুবিধা পাব। বিশেষ করে নৌবাণিজ্য খাতে সুযোগ-সুবিধা বাড়বে। দুদেশের মধ্যে পণ্য পরিবহন খরচ কমে যাবে ও সময় সাশ্রয় হবে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে কোস্টাল শিপিং এগ্রিমেন্ট হলে দেশটির বন্দরগুলোতে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ বিশেষ সুবিধা পাবে। আমাদের জাহাজগুলোকে তারা অগ্রাধিকারভিত্তিতে বার্থিং সুবিধা দেবে, আমরা ট্যারিফ কনসেশন পাব। চুক্তি স্বাক্ষরের পর বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন ও সিলন শিপিং কর্পোরেশনের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠবে। এতে আমাদের মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ও ক্রুদের জন্য শ্রীলঙ্কার জাহাজগুলোতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশের নাবিকদের ভিসা ইস্যুর ক্ষেত্রেও তারা (শ্রীলঙ্কা) প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেবে। এছাড়া কলম্বো ও হাম্বানতোতা বন্দর ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সুবিধা পাবে।