তিন যুগ আগে যখন দেশে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (সিইপিজেড) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইপিজেড ধারণার প্রবর্তন হয় প্রায় সে সময়কার অল্প কয়েকটি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি শ্রীলঙ্কার ইউনিভোগ গার্মেন্ট। ইউনিভোগের হাত ধরে চট্টগ্রাম ইপিজেডে একে একে আগমন রিজেন্সি গার্মেন্ট, কেন্টপার্ক (বিডি), ফারগাজমের মতো কম্পানিগুলোর। বর্তমানে হাতেগোনা যে কয়েকটি কম্পানি পেশাদারিত্ব, কমপ্লাইয়েন্স ও কর্মদক্ষতায় ইপিজেডে আধিপত্য বজায় রেখেছে তার মধ্যে রিজেন্সি গার্মেন্ট ও কেন্টপার্ক (বিডি) অবশ্যই একেবারে সামনের সারিতে।
বেপজা সূত্র জানায়, বর্তমানে বেপজার চারটি ইপিজেডে শ্রীলঙ্কান প্রতিষ্ঠান হিসেবে ৮টি কারখানা চালু আছে। আর বাস্তবায়নাধীন আছে আরো দুটি কারখানা। এই কারখানাগুলো থেকে গত অর্থবছরে ২৭১ দশমিক ৯৭ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। শ্রীলঙ্কান কারখানায় এ পর্যন্ত বিনিয়োগ হয়েছে ১৩৬ দশমিক ৫২ মিলিয়ন ডলার। আর কর্মসংস্থান হয়েছে ১৯ হাজার ১৫৭ জন বাংলাদেশির। সব মিলিয়ে শ্রীলঙ্কান কারখানাগুলো থেকে এ পর্যন্ত ১ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
তবে প্রকৃত রপ্তানি চিত্র এর চেয়ে আরো অনেক বেশি, যা সরকারি তথ্য বিবরণীতে আসে না। কারণ ইপিজেডে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো শ্রীলঙ্কান প্রতিষ্ঠান হিসেবে চেনে কিন্তু নিবন্ধন নেওয়া আছে অন্য দেশের নামে। যেমন রিজেন্সি এবং কেন্টপার্ক। চট্টগ্রাম ইপিজেডের অন্যতম বৃহৎ কম্পানি দুটি শ্রীলঙ্কার বিখ্যাত হায়দ্রামনি গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। এই গ্রুপের হেড অফিস কলম্বোর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে। কিন্তু রিজেন্সির নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নামে। একইভাবে চট্টগ্রাম ইপিজেডের কেন্টপার্ক বাংলাদেশ লিমিটেড যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধিত। শ্রীলঙ্কার ইউনিভোগ গ্রুপের ইউনিভোগ গার্মেন্ট কম্পানি লিমিটেডের নিবন্ধন হয়েছে হংকংয়ের প্রতিষ্ঠান হিসেবে। কিন্তু এই গ্রুপের হেড অফিসও কলম্বোর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে।
চট্টগ্রাম ইপিজেডে কেন্টপার্ক যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধন নিলেও কর্ণফুলী ইপিজেড এবং কুমিল্লা ইপিজেডে ঠিকই শ্রীলঙ্কান প্রতিষ্ঠান হিসেবেই নিবন্ধন নিয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন দেশের নামে নিবন্ধন হলেও তিনটি প্রতিষ্ঠানই একই মেনেজমেন্ট দ্বারা পরিচালিত হয়।
বেপজা সূত্র এবং সংশ্লিষ্ট কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরাসরি শ্রীলঙ্কান নিবন্ধিত এবং শ্রীলঙ্কান মালিকানাধীন কিন্তু অন্য দেশের নিবন্ধনে থাকা শুধু চট্টগ্রাম ইপিজেডে অবস্থিত কারখানা থেকে গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৩৪৮ দশমিক ৯৬৯ মিলিয়ন ডলার। অন্যান্য ইপিজেড মিলিয়ে এই রপ্তানির পরিমাণ ৬০৫ দশমিক ৩২৫ মিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে চট্টগ্রাম ইপিজেডে অবস্থিত রিজেন্সি থ্রি লিমিটেড থেকেই রপ্তানি হয়েছে ১৬৬ মিলিয়ন ডলার। সিইপিজেডে অবস্থিত এসব কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে ২১ হাজার ৮৪৮ জন বাংলাদেশির।
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় গ্রুপ ব্র্যান্ডিক্স লঙ্কা কুমিল্লা ইপিজেডে ব্র্যান্ডিক্স ক্যাজুয়াল ওয়্যার নামে একটি কারখানা স্থাপন করছে। যেখানে তারা ১৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। একই ইপিজেডে কেন্টপার্ক ২৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে আরেকটি কারখানা স্থাপন করছে যেখানে প্রায় ৫ হাজার বাংলাদেশির কর্মসংস্থান হবে বলে বেপজা কর্তৃপক্ষ আশা করছে।
বেপজার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘শ্রীলঙ্কান কারখানাগুলো খুবই স্মার্ট। ইপিজেডগুলোতে তাদের প্রতিষ্ঠান কম হলেও বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং রপ্তানি অত্যন্ত ভালো। যে কয়টি কম্পানি ইপিজেডগুলোতে আছে এর সবগুলোই শতভাগ কমপ্লাইয়েন্স। এই কম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তেমন অভিযোগ পাওয়া যায় না। তাদের কর্মদক্ষতার আর অভিজ্ঞতার কারণে কম্পানিগুলোর বিনিয়োগও বাড়ছে। ’
তিনি বলেন, ‘ইপিজেডে একেবারেই শুরুর দিকেই শ্রীলঙ্কানদের আগমন। শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধের কারণে তারা বাংলাদেশমুখী হয়। ’
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে শ্রীলঙ্কার অবদান শুধু বিনিয়োগে নয়, বরং আরো ব্যাপক। গার্মেন্ট মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে এমন অনেক দেশি-বিদেশি কারখানা আছে যেখানে পরিচালনার দায়িত্বে আছে শ্রীলঙ্কানরা। গার্মেন্ট ব্যবসার বিশেষ করে প্রশাসনিক এবং মার্চেন্ডাইজিংয়ে শ্রীলঙ্কানরা অনেক বেশি পেশাদার এবং দক্ষ। বাংলাদেশে গার্মেন্টশিল্পের বিকাশে তাই শ্রীলঙ্কার অবদান অনস্বীকার্য।
বেপজার মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) নাজমা বিনতে আলমগীর এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ইপিজেডগুলোতে যতগুলো কারখানা আছে এর মধ্যে শ্রীলঙ্কান মালিকানাধীন কারখানাগুলো গুণগতমান, পরিচালনা এবং শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে সেরা দুই-তিনটির মধ্যেই থাকবে। তারা অনেক বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং পেশাদার। গার্মেন্ট সেক্টরটি তারা বোঝেও ভালো। যে কারণে শ্রীলঙ্কান মালিকানাধীন কম্পানিগুলোর সব বিনিয়োগ পোশাক সেক্টরে। ’