জীবন সংগ্রামে জয়ী একজন নারীর গল্প

স্বামীর মৃত্যুর সময় মনোয়ারা বেগম আট মাসের গর্ভবতী। তারপর যথাসময়ে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। নাম রাখা হয় ইসমাইল। ইসমাইল এখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। মনোয়ারার স্বামী মারা যাওয়ার সময় বড় ছেলে রুস্তম তখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ত। মেয়ে আমিনার বয়স ছিল ৬ বছর। এরই মধ্যে মনোয়ারার খুব কষ্টে কেটেছে কয়েকটি বছর। কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার উপজেলায় বাড়ি ছিল। জমি সংক্রান্ত পূর্ব শত্রুাতার জের ধরে মনোয়ারার স্বামীকে রাতের অন্ধকারে কুপিয়ে জখম করে। প্রায় ছয় মাস চিকিৎসার পর তার স্বামী মারা যায়। স্বামীর মৃত্যুর পর মনোয়ারা আর স্বামীর ভিটায় থাকতে পারেননি। শত্রু পক্ষের ভয় ভীতিতে তাকে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিতে হয়। কিন্তু তিনটি ছোট ছোট সন্তান নিয়ে কোথায়ই-বা আশ্রয় পাবেন সে। এ অবস্থায় সে উপজেলা সদরের কাছে ছোট একটি ঘর ভাড়া নেন তিনি।
এরইমধ্যে মনোয়ারা বেগমের সাথে দেবীদ্বার উপজেলার মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার দেখা হয়। মনোয়ারা বেগম তার কষ্টের কথা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কাছে বলেন। কাহিনী শুনে তিনি মনোয়ারাকে তার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এক মাসের একটি সেলাই প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নিতে বলেন। আগ্রহ ও একাগ্রতার ফলে এক মাসের মধ্যে মনোয়ারা সেলাইয়ের সব কিছু শিখে ফেলেন। উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নারীদের আয়বদ্ধক কর্মসূচির আওতায় তাকে একটি সেলাই মেশিন কিনে দেন। প্রথমে নিজের বাসায় মেয়েদের জামা কাপড় তৈরির কাজ শুরু করেন। তার কাজ ভালো হওয়ায় দূর থেকে নারীরা বস্নাউজ, স্যালোয়ার, কামিজ তৈরির জন্য আসতে থাকে। কাজের চাহিদা বাড়ায় মনোয়ারা উপজেলা সদরে একটি রুম ভাড়া নিয়ে একটু বড় পরিসরে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যে মনোয়ারার সেলাইয়ের দোকান বেশ জমে ওঠে। সন্তানরাও মনোয়ারাকে কাজ সহায়তা করে। উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা একজন অত্যন্ত দায়িত্বশীল মানুষ। তিনি মাঝে মাঝেই মনোয়ারার খোঁজ খবর রাখেন। মনোয়ারা বেগমের সেলাই কাজে আয় রোজগার বাড়ায় দোকানে কাপড় তুলতে শুরু করলেন। কাস্টমারদের আর বাইরে থেকে কাপড় কিনতে হয় না। তার দোকন থেকেই কাপড় কিনে সেখানেই সেলাই করে। এতে মনোয়ারার মুনাফা এবং ব্যবসার পরিধি দুটোই বাড়তে থাকে।
দর্জির কাজ করে টাকা-পয়সা রেজগার করাই মনোয়ারা বেগমের একমাত্র লক্ষ্য নয়। তার লক্ষ্য হল ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। স্বামীর মৃত্যুর পর বড় ছেলে রুস্তমের লেখাপড়ায় কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে। তখন রুস্তমকে মায়ের সেলাইয়ের কাজে সময় দিতে হত। কাজে সাহায্য করতে গিয়ে সন্তানের লেখাপড়ার ক্ষতি হোক এটা মনোয়ারা কিছুতেই চায় না। দোকানের কাজের ফাঁকে ফাঁকে রুস্তম লেখাপড়া চালিয়ে যায়। লেখাপড়ায় রুস্তমের বেশ আগ্রহ ছিল।
মনোয়ারা বেগম একজন সংগ্রামী নারী। স্বামীর অকাল মৃত্যুতে তিনি মনোবল হারাননি। বিপদ মোকাবিলা করেছেন। স্বামীর জমি-জমা বলতে কিছুই ছিল না। একমাত্র ভিটা মাটি থেকেও উচ্ছেদ হয়েছেন তিনি। এ বিপদ থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে মনোয়ারা বেগম একজন ব্যতিক্রম ধর্মী সংগ্রামী নারী।
তিনটি সন্তানসহ সর্বশান্ত মনোয়ারার পক্ষে কোন রকমে বেঁচে থাকাই ছিল দায়। কিন্তু তিন জীবন যুদ্ধে পরাজিত হয়নি। জীবনের রূঢ় বাস্তবতা তাকে আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলেছেন। দোকানের কাজে সহায়তার পশাপাশি বড় ছেলে রুস্তমের লেখা পড়া চলতে থাকে। ছোট্ট রুস্তমকে মা শুনিয়েছে লেখাপড়া শিখে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মায়ের কষ্ট ঘুচাতে হবে। মায়ের এ আশার বাণী আর তার হাড়ভাঙ্গা খাটুনি থেকে রুস্তম জীবনের কঠিন বাস্তব শিক্ষাটিই পেয়েছে। এরইমধ্যে ছোট ছেলে ইসমাইল স্কুলে যায়। মনোয়ারা ছেলে-মেয়েদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ না করে বয়স হওয়া মাত্রই তাদের স্কুলে পাঠিয়েছেন। শিক্ষা ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্যই প্রয়োজন এ সত্য মনোয়ারা জীবন থেকে উপলব্ধি করেছেন।
মনোয়ারা বেগম শুধু তার ছেলে মেয়েদের বিদ্যালয়ের শিক্ষাই নিশ্চিত করেনি, জীবন-জীবিকার শিক্ষাও দিয়েছে। তার মেয়েটিও ছোট বেলা থেকে মাকে সেলাই কাজে সাহায্য করেছে। সেও সেলাই কাজে পারদর্শিতা অর্জন করেছে। এছাড়াও তিনি মেয়েকে বাটিক, বুটিক, এমব্রয়ডারি, বাঁশ-বেতের কাজসহ ঘর গৃহস্থালীর সব কাজ প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। মনোয়ারার চিন্তা হলো তার মত তার মেয়ে যেনো কোনো কারণে কোনো সময় বিপদগ্রস্ত হতে না হয়। আকস্মিক কোন বিপদে তারা যেন জীবন যুদ্ধে হেরে না যায়, তাই তার প্রত্যেক ছেলে মেয়েকে আয়-রোজগার করার মত বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন।
মনোয়ারা বেগমের ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। বড় ছেলে রুস্তম কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে অনেক টাকা রোজগার করছে। মেয়ে আমিনার বিএ পাশ করার পর ভাল পাত্রে সাথে বিয়ে হয়েছে। আমিনার স্বামী সৌদি আরবে ভলো বেতন চাকুরি করে। মনোয়ার বেগমের সবচেয়ে ছোট সন্তান ইসমাইল। সে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়ে এখন রংপুর মেডিকেল কলেজে পড়ছে। অত্যন্ত মেধাবী ও পরিশ্রমী ইসমাইল।
প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মনোয়ার বেগম আমাদের সমাজের একজন সংগ্রামী নারীর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দুঃখ-দুর্দশার বিশাল পাহাড় ঠেলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে হাজারো মনোয়ারা বেগমের মত পরিশ্রমী নারীর জন্ম হবে এবং দুঃখ, দুর্দশা আর অভাব অনটনকে পরাজিত করে তারা নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। গোটা দেশকে নিয়ে যাবেন উন্নয়নের দিকে- এ প্রত্যাশা আমাদের সবার।