বিদেশে কদর বেড়েছে বাংলাদেশের ওষুধের। এই ওষুধ এখন এশিয়া, আফ্রিকার বাজার ছাড়িয়ে ইউরোপের বাজারে প্রবেশ করেছে। গার্মেন্টসের পর এখন ওষুধ শিল্পকে রফতানি আয়ের একটি অন্যতম খাত হিসেবে ধরা হচ্ছে। গত আট বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওষুধ রফতানির পরিমাণ সাতগুণ বেড়েছে। ২০০৯ সালে ৭৩টি দেশে ওষুধ রফতানির পরিমাণ ছিল ৩শ’ ৪৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা। ২০১৬ সালে এসে ১২৭টি দেশে ওষুধ রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ২শ’ ৪৭ কোটি পাঁচ লাখ টাকায়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষায় এ চিত্র পাওয়া গেছে। এই প্রতিবেদনে ওষুধ শিল্প সম্পর্কে বলা হয়, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ওষুধপ্রাপ্তি মূলত আমদানির ওপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে অনেক উচ্চ মূল্যে জনগণকে ওষুধ কিনতে হত। কিন্তু বাংলাদেশ বর্তমানে দেশের চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধ দেশে উৎপাদন করছে। বর্তমানে শুধু কিছু হাইটেক প্রোডাক্ট যেমন ব্লাড বায়োসিমিলার, অ্যান্টিক্যান্সার ড্রাগ ও ভ্যাকসিন ইত্যাদি আমদানি হয়।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ওষুধ আমদানিকারক দেশ থেকে রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। সারাবিশ্বে বাংলাদেশের ওষুধ সুনাম অর্জন করেছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ওষুধ প্রস্তুতকারী কারখানার সংখ্যা ৮৫১টি। এর মধ্যে অ্যালোপেথিক ২৬৬টি, ইউনানি ২৬টি, আয়ুর্বেদিক ২০৭টি, হোমিওপ্যাথি ৭৯টি ও হার্বাল ৩২টি। বর্তমানে অনুমোদিত ২৬ হাজার ৯১০টি ব্র্যান্ডের অ্যালোপেথিক ওষুধ বাজারে রয়েছে।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জানান, দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন প্রকার ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামাল বিশ্বের ১২৭টি দেশে রফতানি হচ্ছে। আর দেশে মোট চাহিদার ৯৮ শতাংশ ওষুধ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়।
বছরওয়ারি ওষুধ রফতানির পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৯ সালে ৩শ’ ৪৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা, ২০১০ সালে ৩শ’ ৩২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, ২০১১ সালে ৪শ’ ২৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা, ২০১২ সালে ৫শ’ ৫১ কোটি ২২ লাখ টাকা, ২০১৩ সালে ৬শ’ ১৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, ২০১৪ সালে ৭শ’ ৩৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা, ২০১৫ সালে এক হাজার আট কোটি আট লাখ টাকা ও ২০১৬ সালে দুই হাজার ২শ’ ৪৭ কোটি পাঁচ লাখ টাকা।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, সদ্যসমাপ্ত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ওষুধ রফতানির পরিমাণ বেড়েছে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে ওষুধ রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ কোটি মার্কিন ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ৮ কোটি ২১ লাখ ডলার; যা দেশি মুদ্রায় প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা। আগের বছর আয় ছিল ৭ কোটি ২৬ লাখ ডলার বা ৫৬৬ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে এ খাতে আয় ছিল ৪ কোটি ৮২ লাখ ডলার বা ৩৭৫ কোটি টাকা।
রফতানি বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোতে বাংলাদেশের ওষুধের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের পুরো বাজার ধরতে পারলে তা ৩০-৩৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াবে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ কোম্পানি বেক্সিমকো, স্কয়ার যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ রফতানির জন্য নিবন্ধন পেয়েছে। এখন রফতানির অপেক্ষা। আর ইনসেপ্টার নিবন্ধন পাওয়া চূড়ান্ত প্রক্রিয়ায় রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ১০৫টির বেশি দেশে এ বাংলাদেশের ওষুধের বাজার রয়েছে।
ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস বা জিএমপি অনুসরণ করতে হয়। শর্তগুলো সম্প্রতি আরো কঠিন হয়েছে, যা সিজিএমপি বা কারেন্ট গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস নামে পরিচিত।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী সম্প্রতি জাতীয় সংসদকে জানিয়েছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জিএমপি (গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্রাকটিস) গাইডলাইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করায় এবং ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদনের দায়ে ৮৬টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স সাময়িক এবং ১৯টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থায়ীভাবে বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদনের জন্য জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ২০১৬-এর মধ্যে ৬১টি পদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল ও ১৪টি পদের রেজিস্ট্রেশন সাময়িক বাতিলসহ প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
ওষুধ শিল্পের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে ওষুধ শিল্পের প্রায় ৮০ শতাংশ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হচ্ছে। তাই মূল্যবান এ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে হলে প্রস্তাবিত কাঁচামাল উৎপাদনের শিল্পপার্ক নির্মাণে হাত দিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ ওষুধ তৈরির কাঁচামাল উৎপাদনে যাওয়ার জন্য এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার ওষুধ শিল্পপার্ক স্থাপন শেষ হলে এখানেই ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদিত হবে। এটা সম্ভব হলে আগামীতে ওষুধ রফতানি আরো বাড়বে।