কংক্রিটের নগরীতে সবুজের সমারোহ

এত সবুজ যে চোখে ঘোর লেগে যায়। কংক্রিটের নগরীতে বৃক্ষমেলা যেন মরূদ্যান হয়ে হাজির হয়েছে। হাজার রকমের গাছ। ছোট ছোট গাছে ফল ধরেছে। বাহারি ফুলের সৌন্দর্য তো রয়েছেই। তবে বৃক্ষমেলায় নজর কাড়ে এই ফলের গাছগুলো। এখন জ্যৈষ্ঠ মাস। আমের সময়। বৃক্ষমেলা এক চক্কর ঘুরে মনে হবে যেন আমের বাগানে চলে এসেছেন।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে বাণিজ্য মেলার মাঠে শুরু হয়েছে মাসব্যাপী বৃক্ষমেলা। এর সঙ্গেই শুরু হয়েছে পাঁচদিনের পরিবেশ মেলা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত রবিবার মেলার উদ্বোধন করেন। এবারের স্লোগান ‘বৃক্ষ রোপণ করে যে, সম্পদশালী হয় সে’। রাজধানীতে প্রতি বছরই জাতীয় বৃক্ষমেলা আয়োজন শহরের মানুষদের কাছে সবুজ প্রাণের হাতছানি নিয়ে উপস্থিত হয়। দ্বিতীয় দিনেই বেশ জমে উঠেছে মেলা। আকাশ কালো করা মেঘ, কালবৈশাখীর আশঙ্কা উপেক্ষা করে চলে এসেছেন বৃক্ষপ্রেমীরা। ঘুরে ঘুরে গাছের খোঁজ করছেন। প্রয়োজনমতো কিনছেন।

কানাডার জাতীয় পরিবেশ এজেন্সির গবেষণা প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে ‘গড়পড়তায়একটি বৃক্ষ থেকে বছরে ২৬০ পাউন্ড অক্সিজেন তৈরি হয়। আর দুটি পরিপূর্ণ বৃক্ষ যে অক্সিজেন সরবরাহ করে, তা চার সদস্যের একটি পরিবারের জন্য যথেষ্ট।’ তাই নির্দ্বিধায় স্বীকার করতেই হবে বৃক্ষের মতো উপকারী বন্ধু-আত্মীয় হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো পৃথিবীতে আর কেউ নেই।

মানুষের সেই পরম বন্ধুর যেন মেলা বসেছে। তাই বৃক্ষমেলায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই মন ভালো হয়ে যায়। সারি সারি স্টল। স্টলের সামনে সাজানো শত শত গাছ। সেইসব গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে ঘুরে গাছ কিনছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। এ মেলায় ৭৩টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি নার্সারি ৬৭টি, সরকারি ৬টি। মেলার মোট স্টলের সংখ্যা ১০০টি। শুধু রাজধানীতে মাসব্যাপী মেলাই নয় বন বিভাগ সারাদেশ জুড়ে বৃক্ষমেলার আয়োজন করে থাকে। এর মধ্যে বিভাগীয় পর্যায়ে ১৫ দিন, জেলা ও থানা পর্যায়ে সাত দিনের বৃক্ষমেলা বসে।

বন অধিদপ্তরের সহকারী বন সংরক্ষক হুমায়ূন কবীর জানালেন, গাছ লাগানোর প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। এর সুফল হিসেবে দেশের বনভূমির পরিমাণ বেড়েছে। বন বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগে সামাজিক বনায়নের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, গত শতকের নব্বই-এর দশকে দেশের বনভূমি কমে ৯ ভাগে এসে দাঁড়ায়। এখন দেশের বনভূমি সাড়ে ১৭ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে পৌনে ৭ শতাংশ সামাজিক বনায়নে সৃষ্ট বনভূমি।

বৃক্ষমেলায় এক চক্কর

এখন রাজধানীতে ছাদে বাগান করার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে মানুষের। মেলায় স্টলগুলোতে ছাদের বাগানের উপযোগী গাছের সংগ্রহ অনেক। রয়েছে অর্কিড, বনজ, ফলদ ও ফুলের গাছ। নার্সারির মালিকরা জানালেন, মানুষের ফলদ গাছের প্রতি আগ্রহ বেশি। আম গাছ বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি। জাতীয় বৃক্ষের প্রতি মানুষের আগ্রহ দেখে নানা জাতের আমগাছের সমাহার মেলায়। এর মধ্যে ল্যাংড়া, ফজলি, হিমসাগরের নাম তো সবার জানা। হালে আম্রপালিও বেশ জনপ্রিয়। তবে লতা বোম্বাই, আরটি ২, ক্যান, পালমার, মহাচনক, ফোর কেজি প্রভৃতি বিদেশি জাতের আমগাছের কদর বাড়ছে।

কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন ১৩৯ জাতের গাছের চারা নিয়ে এসেছে বৃক্ষমেলায়। এরমধ্যে ফলের জাত ৬৭টি, ফুলের জাত ৩৫টি, ওষুধি ২০, বনজ ৩, মসলা ৮, অর্কিড ৩ ধরনের। কৃষিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম জানালেন, মানুষের মাঝে সচেতনতা বেড়েছে। তারা নতুন জাতের খোঁজ নিয়ে গাছ লাগাচ্ছেন। গাছের গুরুত্ব বুঝতে শিখছে মানুষ। তিনি জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নতুন জাতের গাছ দেশের আবহাওয়ায় গড়ে তুলে তা রোপণের জন্য উত্সাহিত করছে। সম্প্রতি ব্রাজিলের ফল ‘জাম্বুটিকাবা’ দেশে লাগানেরা কাজ করছে এ কর্পোরেশন। এছাড়া, এলাচি চাষের গবেষণা চলছে বলে জানান তিনি।

মেলায় নানা ধরনের অর্কিডের সংগ্রহ রয়েছে। স্কয়ার নার্সারির বিক্রয় প্রতিনিধি জাহিদুল হক বলেন, অর্কিডের চাহিদা রয়েছে। ইনডোর প্ল্যান্টের প্রতি আগ্রহ রয়েছে ক্রেতাদের। তাছাড়া ফুলের গাছের চাহিদাও বাড়ছে। এসবের সংগ্রহ রয়েছে তাদের স্টলে। লিভিং আর্ট নামের স্টলে অন্যান্য গাছের পাশাপাশি মিলবে নানা ধরনের বনসাই। এ স্টলের বিক্রয় প্রতিনিধি জাহিদা হাসান জানালেন, তাদের স্টলে প্রায় ৩০০ ধরনের বনসাই রয়েছে। এরমধ্যে কাঁঠালি বটের বনসাই রয়েছে পৌনে দুই লাখ টাকা দামের। এছাড়া সর্বনিম্ন এক হাজারে মিলবে বনসাই। কামিনি, জুনিপার, আম, চাইনিজ বটসহ নানা ধরনের গাছের বনসাই রয়েছে এই স্টলে।

ছাদে বাগান করতে প্রশিক্ষণ

মানুষের মাঝে ছাদে বাগান জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় ছাদে বাগান করতে প্রশিক্ষণও চালু হয়েছে। বারিধারার উন্নয়ন সংস্থা ‘লাইফ টু নেচার’ ছাদে বাগান করার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এছাড়া অনলাইনে ছাদে বাগানের টিপসও দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এ প্রতিষ্ঠানের স্টল রয়েছে বৃক্ষমেলায়। এখানকার সমন্বয়ক হোসনে আরা খানম ও কামরুন নাহার বিনা জানান, ছাদে বাগানের ক্ষেত্রে একেক ধরনের গাছের জন্য একেক রকম যত্ন প্রয়োজন হয়। সেজন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। ছাদে বাগান করার কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সেসব কিভাবে কাটানো যায় সেসব জানান জরুরি।

রকমারি গাছ

এবারের বৃক্ষমেলায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিক্রি ও প্রদশর্নীকে কেন্দ্র করে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রভৃতি সরকারি প্রতিষ্ঠান। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের স্টলে মাসব্যাপী এ মেলায় আগ্রহী দর্শনার্থীদের বাড়ির ছাদে বাগান করার পদ্ধতি, গাছের রোগ-বালাই দমন পদ্ধতি, একটি বাড়ি, একটি খামার তৈরি করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এছাড়া রাবার চাষ, সংগ্রহ ও ব্যবহারের নানা পদ্ধতি প্রদর্শন করা হচ্ছে বন শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের স্টলে। কঞ্চি কলম পদ্ধতিতে বাঁশ চাষের নানা পদ্ধতি প্রদর্শন করা হয়েছে বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্টলে।

মেলায় ঘুরে ঘুরে দেখা যায় বাহারি সব বৃক্ষের সমাহার। শোভাবর্ধক বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে প্যাগোড, বিভিন্ন রকমের ক্যাকটাস, সাইকাস লাউ, পাতা লতা, এথনোরিয়াম, বিভিন্ন রকমের বনসাঁই, ফিছুদিয়া পাম, কুচিয়াবল, মুনস্টার, বিচিত্র ড্রেসিনা, বনঝাউ, নদীঝাউ অন্যান্য। ঔষধি গাছ নিয়ে এসেছে ডজনখানেক নার্সারি। এসব গাছের মধ্যে রয়েছে দারুচিনি, জাকের আন্দা, আলুবেড়া, পোলাউ পাতা, মিশ্র মসলা, পাথরকুচি, অরহল, উলটকম্বল, আকন্দ, বামতুলসী, তুলসী, সজিনা, পুদিনা, চন্দন, তমাল, নাগেশ্বর, অর্জুন, শিমুল, হরীতকী, রেইন্ট্রি, চই, ছাতিয়ান, নাগলিংগম, উলটচন্ডাল, কাঠবাদাম ইত্যাদি।

এলাচি লেবু, জামরুল, মিষ্টি করমচা, আনারস, ডালিম, লটকন, আঙ্গুর, মিশরী ডুমুর, কামরাঙ্গা, বিভিন্ন রকমের পেয়ারা, হরেক রকমের বরইসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাতের নানা মৌসুমের ফলদ বৃক্ষের চারা ও কলম নিয়ে এসেছে অর্ধশতাধিক নার্সারি।

পরিবেশ মেলায়

তরুণদের ভিড়

বৃক্ষমেলার পাশেই বসেছে পরিবেশ মেলা। পরিবেশকে দূষণমুক্ত করার নানা ধরনের প্রকল্প রয়েছে এখানে। তাই এসব প্রকল্পের টানে তরুণ-তরুণীদের আনাগোনা এখানে বেশি। পরিবেশ মেলার স্টলে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা দেখাচ্ছিলেন তাদের প্রজেক্ট। ছাদে বাগান, পরিবেশসম্মত বাড়ি কিভাবে আমাদের চারপাশকে সুন্দর করে তোলে তাদের প্রজেক্টে সেসব বিষয় তুলে ধরেছেন তারা। এই তরুণরা হলেন- রাজীব হোসাইন, রুশমিলা মাসনাদ, আফসানা প্রভা ও নাজিমুদ্দীন। এছাড়া আইইউবিএটির শিক্ষার্থীরা তুলে ধরছেন পরিবেশবান্ধব নগরের মডেল। শিক্ষক ড. আরিফ রেজার সঙ্গে শিক্ষার্থী তাহমিনা আক্তার ও খন্দকার রায়হান হাসান তুলে ধরছিলেন তাদের প্রজেক্টের খুঁটিনাটি।

পরিবেশ মেলায় মোট ৬৮টি স্টল রয়েছে। মেলায় অংশ নিয়ে বিভিন্ন এনজিও পরিবেশ সচেতনতায় তাদের কার্যক্রম তুলে ধরছে। রয়েছে বিষয়বিত্তিক উদ্ভাবনী প্রজেক্ট, পরিবেশ দূষণ রোধে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে তাদের কার্যক্রমও তুলে ধরা হচ্ছে এসব স্টলে। এছাড়া পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন পণ্যের স্টল রয়েছে মেলায়।