সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত

গাছগাছালি ঘেরা ছায়াসুনিবিড় রাজধানীর সবুজবাগের ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহার প্রাঙ্গণ। পাশেই বড় আকারের পুকুর। তাতে থইথই করছে পানি। পুকুরপাড়ে ইফতারির পসরা সাজিয়ে বসেছেন কয়েকজন বৌদ্ধ ভিক্ষু। তাঁদের সামনে টেবিল। তার ওপর থরে থরে সাজানো ইফতারির প্যাকেট। টেবিল ঘিরে দুই সারির দীর্ঘ লাইন। এক সারিতে পুরুষ, অন্য সারিতে মহিলা। তাদের সবাই দুস্থ, অসহায় ও গরিব মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষ। প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় টোকেন। একেকজন আসে, টোকেন জমা দিয়ে সংগ্রহ করে ইফতারি। কোনো ধরনের হট্টগোল ছাড়াই নানা ধর্মের মানুষ সংগ্রহ করে ইফতারির প্যাকেট।

রাজধানীর ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহারে গত শুক্রবার বিকেলে দেখা গেল এ চিত্র। ধর্মীয় সম্প্রীতির এক অনন্য আয়োজন এটি। ধর্মের ভেদাভেদ নয়, মানুষের ভেদাভেদও নয়, মানুষের সেবা দিয়েই যে ঈশ্বরের সেবা মেলে, সে কথা আবারও স্মরণ করিয়ে দিলেন এ বিহারের ভিক্ষুরা। রজমান মাসে প্রতিদিন বিকেলে গরিব ও দুস্থদের মাঝে ইফতারি বিতরণ করে তাঁরা এক উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।

জানা যায়, ১৬ বছর ধরে রোজাদার ও দুস্থ মানুষের মাঝে ইফতারি বিতরণ করে আসছে এ বিহার। প্রতিদিন প্রায় পাঁচ শ রোজাদার ও দুস্থ মানুষ এখান থেকে ইফতারি সংগ্রহ করে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বিকেল ৪টা বাজতেই মহাবিহারের গেটে বিভিন্ন বয়সের নারী ও পুরুষের ভিড় জমতে শুরু করে। আর ইফতারের একটু আগে লাইন ধরে প্যাকেট নিয়ে হাসিমুখে গেট দিয়ে বেরিয়ে আসে দরিদ্র রোজাদাররা।

ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহারের সভাপতি সংঘনায়ন শুদ্ধানন্দ মহাথের। ৮৬ বছর বয়সী এ ভিক্ষুর জীবন কাটছে মানুষের সেবায়। অসুস্থ শরীরেও তিনি ইফতারি বিতরণ কার্যক্রম দেখভাল করেন। আলাপচারিতায় তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৬ বছর ধরে আমরা ইফতারি বিতরণ করছি। আমরা মনে করি, সবার আগে মানুষ। তারপর ধর্ম। ধর্মের কাজ মানুষের সেবা করা। আমরা নানাভাবে মানুষের সেবা করার চেষ্টা করি। প্রতিদিন বিকেলে এখানে শত শত মানুষ আসে। যারাই আসে, তাদের ইফতারি দিই। ’

ধর্মগুরু নিভূতি তেরো বলেন, ‘বিহারের বিশেষ ফান্ড থেকে ওই ইফতারির অর্থের জোগান দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন বৌদ্ধ দেশ ও দাতাগোষ্ঠী থেকে যে সহযোগিতা পাওয়া যায়, তা থেকেও এ খাতে কিছু টাকা ব্যয় করা হয়ে থাকে। প্রতিদিন গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ মানুষকে ইফতারি দেওয়া হয়। কোনো কোনো দিন তার চেয়েও বেশি মানুষ হয়। মানুষ বেশি হলে প্যাকেটও বাড়ানো হয়। ’

বিকেল হতেই বিহার প্রাঙ্গণে লেগে যায় অসংখ্য মানুষের সারি। আশপাশের বিভিন্ন এলাকার বস্তি ও ফুটপাতের গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষ ছুটে আসে। ৬০ বছর বয়সী মনিরা বেগম। খিলগাঁওয়ে বাসাবাড়িতে কাজ করেন। রাতে থাকেন সবুজবাগের এক বস্তিতে। প্রতিদিন বিকেলে তিনি ইফতারি নিতে বিহারে আসেন। মনিরা বেগম বলেন, ‘হোটেল থাইক্যা ইফতারি কিনমো কিভাবে, আমাগোর তো বেশি টেহা নাই। তিন বছর ধইরা এহান থাইক্যা ইফতারি নেই। ইফতারের জন্য আমার আর চিন্তা নাই। ’

বিহারের গেটের কাছে রিকশা দাঁড় করিয়ে ঝটপট ইফতারি সংগ্রহ করেন রিকশাওয়ালা মনির হোসেন। তিনি বলেন, ‘বিকেলের দিকে এদিক দিয়া যাওনের সময় ইফতারি নেই। যারা গরিব মানুষ, তাদের জন্য এইটা খুব উপকারী। খুব সওয়াবের কাজ। বৌদ্ধরা দিচ্ছে বলে ইফতারি নেওয়া যাবে না, আমরা এ নীতি মানি না। গরিবের জন্য এসব নিয়ম কাজে আসে না। ’

বিহারের ভিক্ষু ধর্মরতন শ্রমণ, জিনারতন শ্রমণ, প্রজ্ঞা শ্রমণ বলেন, ‘আমরা বিকেল হলেই পাশের একটি রেস্তোরাঁ থেকে ইফতারি কিনে আনি। ছোলা, বুট, মুড়ি, পেঁয়াজু, খেজুর, জিলাপিসহ নানা সামগ্রী দিয়ে প্যাকেট তৈরি করি। অত্যন্ত স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তা তৈরি করা হয়। এ ছাড়া ইফতারিতে থাকে অন্যান্য সুস্বাদু খাদ্য ও দুই প্রকারের ফল। ’

ইফতারি সংগ্রহ করে রিকশাওয়ালা কাদের মিয়া বলেন, ‘রোজা রেখে একবেলা রিকশা চালাই। বিকেলে চলে আসি বিহারে। এখানে লাইনে দাঁড়ালেই ইফতারি পাওয়া যায়। গরিব মানুষ আমরা, ভালো ইফতারি কিনতে পারি না। বিহারে এই ইফতারির ব্যবস্থা করায় আমরা ভালোভাবে ইফতার করতে পারছি। ’