এসএসসি পাস রূপা এখন বড় ‘উদ্যোক্তা’

‘আমাদের দেশের প্রতিটা মেয়ে হতে পারে এক একজন উদ্যোক্তা। নারীদের সেই দক্ষতা জন্মগতভাবে আছে। আমার পক্ষে যেটা মোটেও সম্ভব ছিল না, সেই কাজটা আমি করেছি মাত্র ৫ বছরের মাথায়। এখন বুঝে গেছি, ‘আমাদের দেশের মেয়েরা অসাধ্য সাধন করতে পারে’—কথাগুলো বলছিলেন রাজবাড়ী জেলার মেয়ে রূপা শেখ। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ব্যবসা শুরু করে ৫ বছরের মাথায় তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী। বর্তমানে রূপার সঙ্গে কাজ করছেন ১২২ জন মেয়ে।

প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা ২১ বছরের তরুণী রূপার মুখে শোনা যাক তার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প—আমি এসএসসি পাস করেছি ২০১১ সালে। এরপর ব্যবসার নেশায় আর লেখাপড়া হয়নি। ওই বছরই ঢাকায় প্রথম আসি ‘জয়িতা’র কার্যক্রম শুরু হওয়ার ৩ দিনের মাথায়। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় তৈরি ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের জন্য পণ্য বিক্রয় কেন্দ্র হচ্ছে ‘জয়িতা’। সেখানে সারা দেশের নারী উদ্যোক্তারা নামমাত্র মূল্যে স্টল বরাদ্দ পায়। এটি ধানমন্ডির রাপা প্লাজার চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় অবস্থিত। সেখানে ডি/এফ-১৬ স্টল বরাদ্দ পাই।

রূপা বলেন, ঢাকায় আসতে বাবা-মা নিষেধ করেছিল। কিন্তু আমি সমিতির টাকা ইনভেস্ট করেছি বলে আর পেছনে ফেরার সুযোগ ছিল না। সমিতিতে অনেক মানুষের জমানো টাকা। তাই বাবা-মায়ের নিষেধ অমান্য করে চলে আসি রাজধানীতে। জয়িতায় দোকান পাই আমাদের সমিতি থেকে। প্রথমে সেটা ছিল ভাতের দোকান। পরে ভাতের দোকানের পরিবর্তে ড্রাইফুডের দোকান নেই। ব্যবসা যে কি জিনিস তা বুঝতে এতা কষ্ট হইছে, যা বলে বোঝানো যাবে না। কিন্তু আমি হারিনি। প্রথম প্রথম মুদির দোকান থেকে মালামাল কিনে এনে বিক্রি শুরু করলাম। জয়িতার স্যারেরা এসে তা দেখে ফেলে দিলেন। এরপরেও নানা প্রতিবন্ধকতা পোহাতে হয়েছে।

এখন জয়িতায় আমার ড্রাই ফুডের দোকানে এমন সব প্রোডাক্ট পাওয়া যায় যা ঢাকার মানুষ ভাবতেও পারে না। যেমন নিমের তেল, সেটা নিমের বিচি থেকে সংগ্রহ করা। অর্জুনের গুঁড়া, কালো জিরা গুঁড়া, কালো জিরার তেল, মেহেদী পাতার গুঁড়া, এগুলো সব রাজবাড়ী থেকে আসে। আমাদের নার্সারিতে মেহেদি পাতা, নিম পাতার চাষ হয়। ওদের কাছ থেকে পাতা এনে শুকিয়ে মেশিনে ভাঙ্গিয়ে প্যাকেট করি। কেউ খায় কেউ ব্যাবহার করে। কালো জিরার তেল ফার্মেসিতে যে দামে বিক্রি হয়, তার চেয়ে অনেক কমে আমরা বিক্রি করছি এবং আমাদেরটার কোয়ালিটিও অনেক ভালো। যারা একবার ব্যবহার করেছেন, তারা বারবার আসেন।

আমার স্টলে, হাতে তৈরি নাড়ু, বাতাসা, খই, মুড়কি, লাল চাল, ঢেকিছাঁটা চাল, হাতে বানানো সেমাইয়ের পিঠা, ডালের বড়ি, খাঁটি সরিষার তেল, তিলের তেল, তিষির তেল, গুঁড় ও চিনির সাজ-বাতাসা, লাল আটাসহ এসব পণ্য পাওয়া যায়।

ব্যবসা শুরু করার পর থেকে বাবা-মার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। কারণ তারা চাইতো না আমি এই ব্যবসা করি। তারা বলতো বাড়ি চলে এসো, ভালো বিয়ে হবে, স্বামী-সংসার হবে। কিন্তু আমি তাতে দমে যাইনি।

আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি; তখন থেকেই ঘরে বসে সেলাইয়ের কাজ করতাম। এখনো অঙ্গনার সেলাই আমরা করি। দোকানের প্রথম দিন আমার বিক্রি ছিল ৬০০ টাকা আর এখন প্রতিদিন ৯/১০ হাজার টাকা। একটু একটু করে এক মাস দেড় মাসের মধ্যে আমার বিক্রি বেড়ে যায়। এখন মনে হয় আমি জয়ী হতে পেরেছি। আমার সমিতিতে এখন ১২২ জন মেয়ে কাজ করে। কেউ মুড়ি ভাজে, কেউ মোয়া বানায়, এভাবে কাজ সবাইকে ভাগ করে দিয়েছি।

বাবার ক্যান্সার হলে ঢাকায় ক্যান্সার হাসপাতালে তিনি ২২দিন ছিলেন। তার সমস্ত ব্যয় আমিই বহন করেছি। বাবার মৃত্যুর পর আমাদের জমি চাচা-ফুপুদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। তখন মা খুব দুঃখ করছিল। মাকে বলেছি, দুঃখ করো না, এই জমি আমি তোমাকে কিনে দিবো। ভাগ হয়ে যাওয়া সেই জমি মাকে কিনে দিয়েছি, ঘর করে দিয়েছি। মাও এখন খুশি।

আমার স্বামীর ইচ্ছা সে তার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটে চলে যাবে। আমরা সেখানেনও যেন দুজনে আলাদা ব্যবসা করতে পারি সেজন্যে বাজারে পাশাপাশি দুটো দোকান রেখেছি। বাগেরহাটের চিংড়ি ব্যবসা এ বছর থেকে শুরু করেছি। এ ভাবেই ধিরে ধিরে নিজেকে এগিয়ে নিচ্ছি।