বর্তমান বিশ্বে যে কটি ইতিবাচক কারণে বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হয় তার মধ্যে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের সাফল্য অন্যতম। তবে এ সাফল্য একদিনে আসেনি, এমনি এমনিও আসেনি। ১৯৮৮ সালে ইউনাইটেড নেশনস অবজারভার মিশন ইন ইরাক-ইরান (টঘওগঙএ)-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের শান্তির দূতরা যে কার্যক্রম শুরু করেছিল ২৯ বছর পর তা আজ পরিণত রূপ লাভ করেছে। আজ বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের প্রতিশব্দ হচ্ছে বাংলাদেশ। শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের উদাহরণ দিতে গিয়ে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করতে হয়। শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের জটিল দায়িত্ব পালনের আগে অন্যান্য দেশের শান্তিরক্ষীরা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং (বিপসট) ঘুরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বিশ্বে ১৯৪৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬৮টি শান্তি মিশনের মধ্যে বাংলাদেশি শান্তি সেনাদের স্পর্শ পেয়েছে ৫৪টি মিশন। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যে ১৩টি মিশনে দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা, মধ্য আফ্রিকার দেশ ডিআর কঙ্গো তাদের অন্যতম। মিশন অ্যাসেসমেন্ট টিমের সদস্য হিসেবে এই ডিআর কঙ্গোতে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের কার্যক্রম দেখার সুযোগ হয় আমার। ২৩,৪৫,৪০৯ বর্গকিমি. আয়তনের দেশটি বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৩ গুণ বড়। তবে এর জনসংখ্যা বাংলাদেশের অর্ধেকেরও কম, প্রায় সাড়ে সাত কোটি। আয়তনে আফ্রিকা মহাদেশের দ্বিতীয় এবং বিশ্বের ১১তম বৃহৎ এ দেশটিতে স¦য়ং স্রষ্টা যেন নিজের হাতে সম্পদ দান করেছেন। হীরা, সোনা, রুপাসহ ৩২ ধরনের মহামূল্যবান খনিজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ডিআর কঙ্গোর মাটির নিচে। তবে কঙ্গোর মানুষের এটাই যেন সবচেয়ে বড় অপরাধ।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : কমিউনিস্ট নেতা প্যাট্রিস লুমুম্বার নেতৃত্বে ১৯৬০ সালে কঙ্গো ঔপনিবেশিক বেলজিয়ামের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করলেও জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটেনি। প্যাট্রিস লুমুম্বা নিহত হন ১৯৬১ সালে। তার অনুসারী লরেন্ট কাবিলা হন দেশান্তরী। স্বৈরশাসক মবুতু ১৯৯৭ পর্যন্ত কঙ্গো শাসন করেন। ১৯৯৭ সালে লরেন্ট কাবিলার মিলিশিয়া বাহিনী এএফডিএল-উগান্ডা, রুয়ান্ডা ও বুরুন্ডির সেনাবাহিনীর সমর্থনে মবুতুকে পরাজিত করেন। বহুমাত্রিক চক্রান্তের জাল ছিন্ন করার চেষ্টা শুরু করেন কাবিলা। কিন্তু চক্রান্তকারীদের হাত এত লম্বা যে উল্টো তাকেই ধরাশায়ী হতে হয়। রহস্যজনকভাবে নিহত হন কাবিলা। মৃত্যুর পর তার ছেলে যোসেফ কাবিলা কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তবে এতে জনগণের ভাগ্যের উন্নয়ন সামান্যই ঘটেছে।
অন্তর করো জয়
ব্রিগেট সদর দপ্তর বুনিয়া থেকে এক ঘণ্টা হেলিকপ্টারে চড়ে মাহাগীতে পৌঁছলাম। এখানে আসার আগে আমরা জানতাম না যে, আমাদের দেশের শান্তিরক্ষীরা হাজার মাইল দূরে মাহাগীকে আরেক খ- বাংলাদেশ বানিয়ে ফেলেছে। তবে এ কাজ করতে তাদের একটি গুলিও খরচ করতে হয়নি। শুধু আন্তরিকতা দিয়ে তাদের মন জয় করা হয়েছে। মাহাগীতে এসে মনে একটি প্রশ্ন জাগে, এখানে স্থানীয়রা আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে কিন্তু বুনিয়াতে আমরা নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া বাইরে বেরোতে পারিনি কেন?
ব্যানবেট-২-এর কমান্ডারসহ অন্যদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম আগে মাহাগীর অবস্থা এমন ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাটালিয়ন ২০০৯ সালে মাহাগীর দায়িত্ব নেয়। তার পর স্থানীয়দের কল্যাণমূলক বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। মেডিক্যাল ক্যাম্প থেকে শুরু করে স্কুল, কমিউনিটি ক্লিনিক, শিশুদের খেলার মাঠ, এলাকায় ছেলেমেয়েদের খেলার সরঞ্জাম প্রদানসহ সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। এর পর থেকেই বদলে গেছে মাহাগীর অবস্থা। সবাই এখন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের বন্ধু ভাবছে।
কী নেই মাহাগীতে! বঙ্গবন্ধু স্কুল, বাংলাদেশ এভিনিউ, বাংলাদেশ-কঙ্গো ফ্রেন্ডশিপ মেডিক্যাল সেন্টার, খেলার মাঠ, সবকিছু। বাংলাদেশের শান্তি সেনারা স্থানীয়দের কাছে কত জনপ্রিয় তা মাহাগীর রাস্তায় বেরোলেই বোঝা যায়। স্থানীয়রা অনেকেই বাংলা বোঝে, এমনকি অনেকেই ভালো বাংলা বলতে পারে। আমরা রাস্তায় বেরোলে স্থানীয়রা বন্ধু কেমন আছ বলে কুশল বিনিময় করে। আমি গর্ববোধ করি যখন কঙ্গোর স্থানীয় জনসাধারণ আমাকে বন্ধু বলে সম্বোধন করে। আমি গর্ববোধ করি যখন ইন্টারনেটে কঙ্গোর মাহাগী সার্চ দেওয়ার পর বাংলাদেশ এভিনিউ, বাংলাদেশ-কঙ্গো ফেন্ডশিপ স্কুল, মেডিক্যাল সেন্টার ইত্যাদি খুঁজে পাওয়া যায়। আমি গর্ববোধ করি যখন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা বিশ্বে শান্তি ফিরিয়ে আনার নেতৃত্ব দেয়। আমার বিশ্বাস এটি শুধু আমার গর্বের বিষয় নয়। এটা হচ্ছে এ দেশের ১৬ কোটি মানুষের গর্বের বিষয়, সবার হৃদয়ের কথা।
মাহাগীতে পৌঁছে আমরা প্রথম পরিদর্শনে গেলাম প্রায় দশ কিমি. দূরে মেডিক্যাল ক্যাম্পে, যেখানে প্রায় কয়েকশ লোক চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। সকাল থেকে প্রায় চারশ লোক চিকিৎসা নিয়েছে। ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এ চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য ২০-৩০ কিমি. দূর থেকেও লোকজন আসে। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ উগান্ডা থেকেও লোকজন আসে এখানে। স্থানীয় এফএম রেডিও ওকাপির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়, কখন কোথায় মেডিক্যাল ক্যাম্প পরিচালনা করা হবে। প্রতি মাসে এ রকম ২টি মেডিক্যাল ক্যাম্প ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তরে প্রতি শনিবার বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া হয়। এর বাইরেও প্রতিদিন অনেক জটিল রোগী ক্যাম্পে চিকিৎসা নিতে আসে। এখানকার প্রধান সমস্যা হচ্ছে ম্যালেরিয়া, এইডস, অপুষ্টি, বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ, সাপে কাটা, আগুনে পোড়া ইত্যাদি। তা ছাড়া ছোটখাটো সার্জারিও করা হয়। বিনামূল্যে দেওয়া হয় ওষুধ।
মেডিক্যাল ক্যাম্পের পাশেই চলছিল স্থানীয় জনগণের সঙ্গে ইন্টারেকশন সভা, মেডিক্যাল ক্যাম্পের মতো এই সভাও প্রত্যেক মাসে বিভিন্ন স্থানে হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা স্থানীয় জনগণের চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে জানতে পারে এবং তাদের সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যে তা পূরণের চেষ্টা করে। মাহাগীর এডমিনিস্ট্রেটর জন ভসকো এসব সভায় উপস্থিত থাকেন। এই এডমিনিস্ট্রেটররা সরকার কর্তৃক মনোনীত হন। তবে আমাদের সঙ্গে পার্থক্য হচ্ছে বংশপরম্পরায় এই এডমিনিস্ট্রেটররা নিয়োগ পান। স্থানীয় এমপি থাকলেও পাঁচ বছর পরপর নির্বাচনের সময় ছাড়া তাদের দেখা যায় না। তাদের সঙ্গে জনগণেরও যোগাযোগ থাকে না। স্থানীয়রা এই এডমিনিস্ট্রেটরদের কাছেই ছুটে যায় যে কোনো বিপদে। এই সভার তথ্যও জনগণ জানতে পারে রেডিও ওকাপির মাধ্যমে।
কঙ্গোর বেতারে বাংলা সুর : রেডিও ওকাপি কঙ্গোর একটি জনপ্রিয় এফএম রেডিওর নাম। কঙ্গোর ওরিয়েন্টাল প্রদেশের মাহাগীতে এ এফএম রেডিও স্টেশন অবস্থিত। এর চারপাশে প্রায় ৮০ কিমি. এলাকার দশর্ক-শ্রোতা এর অনুষ্ঠান শুনতে পায়। এ রেডিওতে প্রতি বুধবার রাত ৮টা ৪৫ মিনিটের বাংলা অনুষ্ঠান প্রচার করে। বাংলাদেশের অনেক জনপ্রিয় গান এতে প্রচার করা হয়। স্থানীয় জনগণ অধীর আগ্রহে এর জন্য অপেক্ষা করে।
মাহাগীর বর্তমান অবস্থা ভালো। তবে যে কোনো সময় এ স্থিতাবস্থা বিঘিœত হতে পারে। এর কারণ হচ্ছে সেখানকার দুর্বল অর্থনীতি, দুর্বল স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় শাসন, সব মিলিশিয়ার সরকারি বাহিনী এফএআরডিসি (দি আর্মড ফোর্সেস অব দ্য ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো)-তে যোগ না দেওয়া ইত্যাদি। মাহাগীতে সক্রিয় আছে লর্ড রেসিসটেন্স আর্মি (এলআরএ)। যোসেফ কনির নেতৃত্বে ২০০৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তা ছাড়া মরগান গ্রুপ নামে একটি মিলিশিয়া বাহিনী এবং আর্মি ফর লিবারেশন্স অব কঙ্গোলিজ পিউপলও (এলপিসি) এখানে সক্রিয়। তারা সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন আক্রমণের মাধ্যমে তাদের অবস্থান জানান দিচ্ছে।
সম্ভাবনা : আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির নাম বিশ্বদরবারে ছড়িয়ে দিতে অক্লান্তভাবে লড়ে যাচ্ছে আমাদের শান্তি সেনারা। তারা বহুমাত্রিকভাবে আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন শান্তি মিশনের মাধ্যমে যে রেমিট্যান্স আসছে তার অবদানও কিন্তু অর্থনীতিতে কম নয়। সবচেয়ে বড় যে কাজটি তারা করেছে তা হচ্ছে দেশের ইতিবাচক একটি ভাবমূর্তি বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করা। তবে এ ভাবমূর্তির মাধ্যমে বিশ্বে একটি অবস্থান তৈরি করার দায়িত্ব সরকার ও ব্যবসায়ীদের। আমাদের দেশের শান্তিরক্ষীরা যে দেশেই গেছেন সে দেশের মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। সিয়েরা লিত্তনে বাংলা আজ একটি সরকারি ভাষা। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সিয়েরা লিত্তনসহ শান্তিরক্ষা মিশন সম্পন্ন করা অন্যান্য দেশে ব্যবসা শুরু করতে পারে। ওইসব দেশের রয়েছে বিস্তীর্ণ মাঠ, যার অধিকাংশই অনাবাদি। এসব জমি লিজ নিয়ে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে কৃষিকাজ শুরু করা যায়। কৃষিকাজের জন্য এ দেশ থেকে শ্রমিক নিয়ে যাওয়া যায়। এতে করে বিপুলসংখ্যক জনগণের কর্মসংস্থান হবে, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে। বেসরকারিভাবে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান কৃষিকাজ শুরু করতে চাইলেও সরকারি বিধির কারণে বিনিয়োগ করতে পারে না, পুঁজি স্থানান্তর করতে পারে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এসব করেও আমরা কি পারছি জনগণের কষ্টার্জিত টাকা বিদেশে পাচার ঠেকাতে? কঙ্গো, উগান্ডা প্রভৃতি দেশে ভারত, চীন তাদের ব্যবসা বিস্তৃত করেছে। এসব দেশের জনগণের কাছে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তির কারণে আমাদের পক্ষে আরও সহজে ব্যবসা করা সম্ভব ছিল। এগিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল আমাদের দেশের অর্থনীতিকে। আজ সময় এসেছে, এ বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবার, শান্তির জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রায় ১৩২ জন শহীদের রক্তের প্রতি সম্মান দেখানোর। তবে তা শুরু করতে হবে এখনই। পিছিয়ে পড়ার আর কোনো সুযোগ নেই, সময়ও নেই।