উৎসবের আমেজ কেরানীগঞ্জের গার্মেন্টসপল্লীতে

চলে এসেছে পবিত্র রমজান মাস। রমজান শেষ হলেই আসবে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। উৎসবটিকে ঘিরে বাংলাদেশের মুসলমানদের কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়। দেশীয় পোশাকের অধিকাংশ চাহিদা পূরণ করে থাকে কেরানীগঞ্জের মিনি গার্মেন্টসগুলো। রমজান তথা ঈদ উপলক্ষে তাই উৎসব বিরাজ করছে মিনি গার্মেন্টসপল্লী খ্যাত দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে।
সত্তর-আশির দশকে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের বিপ্লবের তালে তালে আশির দশকে কেরানীগঞ্জে গড়ে ওঠে এ গার্মেন্টসপল্লী। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জ, আগানগর, পূর্ব আগানগর, চৌধুরীনগর, নাগরমহল, ইস্পাহানী এলাকা কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এ পল্লী। এসব এলাকাজুড়ে রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজারের মতো শো-রুম আর তিন হাজারের মতো কারখানা। এসব কারখানা ও শো-রুমে কাজ করে প্রায় দুই লাখের মতো শ্রমিক।
কেরানীগঞ্জের এ গার্মেন্টসপল্লীর অধিকাংশই রয়েছে জিন্স প্যান্টের দখলে। আদিয়াত প্যান্ট হাউসের আবদুর রাজ্জাক বলেন, এখানকার জিন্স প্যান্ট সারাদেশের মার্কেটগুলোতে যাচ্ছে। দামে কম ও মানে ভালো হওয়ায় এ অঞ্চলের পোশাকের প্রতি সারাদেশের মানুষের আস্থা আছে। দেশের অধিকাংশ দোকানদার এখানে আসেন জিন্স প্যান্ট কিনতে। মানভেদে তার দোকানে ৪৫০ টাকা, ৫৫০-৫৮০ টাকা, ৬০০-৮০০ টাকা দামের জিন্স প্যান্ট পাওয়া যায় বলেও জানান তিনি। নুর সুপার মার্কেটে গিয়ে একটু কম দামি জিন্স চোখে পড়ল। আল শিপন প্যান্ট হাউসের আবদুর রহমান বলেন, তার দোকানে বড়দের জিন্স প্যান্ট বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৬০০ টাকায় আর ছোটদের জিন্স প্যান্ট বিক্রি হচ্ছে ২০০-৪০০ টাকায়। এ মার্কেটে এর চেয়েও কম দামে জিন্স প্যান্ট মেলে বলে জানান তিনি।
জিন্সের পাশাপাশি গ্যাবার্ডিন প্যান্টেরও রমরমা ব্যবসা জমে উঠেছে এ অঞ্চলে। গ্যাবার্ডিনের দাম প্রায় জিন্সের মতোই।
একেকটি গ্যাবার্ডিন প্যান্ট বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৬৫০ টাকায়। বাজারে ইদানীং গ্যাবার্ডিন প্যান্টের চাহিদা কম বলে দাবি করেন আওয়াল টাওয়ারের জুয়েল প্যান্ট হাউসের মো. মাহবুব আলম। তিনি বলেন, ডিজাইন কম হওয়ায় দিন দিন গ্যাবার্ডিন প্যান্টের চাহিদা কমে যাচ্ছে। যারা আগে গ্যাবার্ডিন প্যান্ট বানাতেন তারা এখন জিন্স প্যান্টের দিকে ঝুঁকছেন। তিনি আরো বলেন, মার্কেটে যে ডিজাইন চলে আমরা সে ডিজাইনই বানাই। গ্যাবার্ডিনের নতুন নতুন ডিজাইন এলে ভালো হতো বলে মনে করেন তিনি।
প্যান্টের পাশাপাশি শার্টও তৈরি হয় এ অঞ্চলে। বড়দের-ছোটদের শার্টের বিশাল সমাহার আছে ইসলাম প্লাজায়। এ মার্কেটের দিনার গার্মেন্টেসের মো. শাহীন ঢালী বলেন, এখানে বিভিন্ন মানের শার্ট পাওয়া যায়। বাংলা শার্ট পাওয়া যায় ১৬০-২২০ টাকায়। চাইনিজ শার্ট পাওয়া যায় ৩২০-৩৮০ টাকায়। ইন্ডিয়ান শার্টের দাম ও চাহিদা বেশি বলে জানান তিনি। প্রতি পিস ইন্ডিয়ান শার্ট পাওয়া যাচ্ছে ৩৮০-৪২০ টাকায়। ইন্ডিয়ান অরবিন্দ শার্টের দাম আরেকটু বেশি, প্রতি পিস ৭০০-৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেরানীগঞ্জে উৎপাদিত এসব শার্টের বিদেশি নামকরণের কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, এ শার্টগুলো এসব দেশের কাপড় দিয়ে তৈরি। সোয়াদিকা হোশিয়ারির মো. করিম বাচ্চাদের শার্টের দাম সম্পর্কে বলেন, ২৮-৩৮ সাইজের শার্ট বিক্রি হচ্ছে ২৫০-২৬০ টাকায় আর ৪০-৪২ সাইজের শার্ট বিক্রি হচ্ছে ২৭০-২৯০ টাকায়। জিরো সাইজের শার্ট ও প্যান্টের সেট বিক্রি হচ্ছে ২০০-২৮০ টাকায়।
কেরানীগঞ্জে বাহারি রকমের পাঞ্জাবিরও দেখা মেলে। পাঞ্জাবির জন্যও এ অঞ্চলের মিনি গার্মেন্টসগুলোর রয়েছে আলাদা সুনাম। পাঞ্জাবির দরদাম সম্পর্কে ধারণা দেন দি আড়ং পাঞ্জাবির মো. আল আমিন। এখানে প্রতি পিস পাঞ্জাবি ৩০০-১৫০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায় বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, কটন পাঞ্জাবি ৩০০-১০০০ টাকা, সিনথেটিক পাঞ্জাবি ৮০০-৯০০ টাকা, সেঞ্চুরি কটন ২০০-১২০০ টাকা, টিস্যু ৭৫০-৯০০ টাকা, লিলেন ৬০০-৬৫০ টাকা, ধুপিয়ান ৮০০-৮৫০ টাকা, কোটা ৫৫০-৬০০ টাকা প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে। প্রতি পিস শেরওয়ানি বিক্রি হচ্ছে ৮০০-১৭৫০ টাকায়। পায়জামা বিক্রি হচ্ছে ১০০-৩৫০ টাকায় আর পাঞ্জাবির ওড়না বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৪০ টাকায়।
মেয়েদের পোশাকের মধ্যে বাচ্চা মেয়েদের পোশাকই তৈরি হয় এখানকার কারখানায়। জয় কালেকশনের সুলতান হোসেন জানান, বাচ্চা মেয়েদের প্রতি পিস ডিজাইন ছাড়া ফ্রক বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৪০০ টাকায়। অন্যদিকে ডিজাইন করা এসব ফ্রক বিক্রি হচ্ছে ৬০০-৬৫০ টাকায়। স্কার্ট পাওয়া যাচ্ছে ৪৫০-৫০০ টাকায়।
নুর সুপার মার্কেটের অনেক দোকানেই চোখে পড়ে নারী ও শিশুরা বসে প্যান্টের সেলাই কাটছে। কথা বলে জানা গেল এসব দোকানের মালিকদের কারখানা আছে। কারখানা থেকে এখানে এনে বাড়তি সুতা কেটে ফেলা হচ্ছে। এসব সেলাই কাটা শ্রমিকদের একজন লিপা আক্তার। সে জানায় ৪৫০০ মাসিক বেতনে এখানে কাজ করে। তার মতো বাকি ৩ জনও একই বেতন পায়। একজন বেশি পায়, যার বেতন ৬৫০০ টাকা।
কেরানীগঞ্জে পাইকারি পোশাক কিনতে আসা অনেকের সঙ্গেই কথা হয়, তাদের মধ্যে নুর হোসেন একজন। নুর হোসেন এসেছেন ভোলা থেকে। ভোলা সদরে ৮ বছর আগে ব্যবসার শুরু থেকেই এখানে পোশাক কিনতে আসেন তিনি। তিনি জনালেন, এখানে জিনিসের দাম কম পাই। মহাজনরাও অনেক সময়ই বাকিতে জিনিস দেয়। এছাড়া মার্কেটগুলো লঞ্চঘাটের পাশে হওয়ায় আমাদের অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগও ভালো। কম খরচেই এগুলো নিতে পারি।
কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. স্বাধীন শেখ বলেন, এখানকার পোশাক দেশের মোট পোশাকের চাহিদার ৪০ শতাংশের ওপরে পূরণ করে থাকে। চায়না, দুবাই থেকে পোশাক না এলে এ অঞ্চলের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা শতভাগ চাহিদা পূরণ করতে পারত। আমাদের অনেক কারখানায় এসব দেশের চেয়ে ভালো মানের জিনিস তৈরি হচ্ছে। আমদানি কমাতে সরকার হস্তক্ষেপ করলে আমরা লাভবান হবো। দেশের টাকাও দেশে থেকে যাবে। সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টির জন্য সরকারকে দৃষ্টি দেয়ার অনুরোধও করেন তিনি।