দেশেই তৈরি হচ্ছে ফ্রুটব্যাগ বাড়ছে চাহিদাদেশেই তৈরি হচ্ছে ফ্রুটব্যাগ বাড়ছে চাহিদা
বিষমুক্ত ও ভালো মানের আম উৎপাদনে ফ্রুটব্যাগ পদ্ধতি বেশ কার্যকর। এত দিন আমদানিনির্ভর হলেও দুই বছর ধরে এটি দেশেই তৈরি হচ্ছে। আর এ ব্যাগ তৈরি হচ্ছে আম উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে। বর্তমানে মাল্টা চাষেও এ ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে এ ব্যাগে চাষের অপেক্ষায় রয়েছে কলা, পেয়ারা, ডালিম, কাঁঠাল, লিচুসহ বেগুন ও করলার মতো সবজিও। এতে দেশে বিষমুক্ত ফল ও সবজি উৎপাদনে যোগ হতে যাচ্ছে নতুন মাত্রা।
জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহারাজপুরে অবস্থিত চাঁপাই অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বর্তমানে আম ও মাল্টা আবাদে ব্যবহার উপযোগী ফ্রুটব্যাগ তৈরি করছে। গত বছর পরীক্ষামূলকভাবে প্রতিষ্ঠানটি ফ্রুটব্যাগ উৎপাদন করেছিল ২২ লাখ পিস। আর এ ব্যাগে উৎপাদিত আমের বড় একটি অংশ বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়েছিল। এ সফলতায় এবার আরো বড় পরিসরে ফ্রুটব্যাগ উৎপাদন করছে প্রতিষ্ঠানটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৮ সালে আমে পরীক্ষামূলকভাবে পলিব্যাগ, কাপড়ে তৈরি ব্যাগ ও ফ্রুটব্যাগ ব্যবহার করে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। এতে ভালো ফলন পাওয়া গেলেও বৃষ্টির কারণে কৃষকদের কয়েকবার ব্যাগ পরিবর্তন করতে হয়েছিল। এর পর ২০১৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে আম আবাদে চীন থেকে আমদানিকৃত ফ্রুটব্যাগ ব্যবহার করে সুফল পায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্র। আর শুরু থেকেই ফ্রুটব্যাগে আম চাষ সম্প্রসারণে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছে সংস্থাটি।
ফ্রুটব্যাগে আম আবাদ নিয়ে গবেষণা ও এ প্রযুক্তি সম্প্রসারণে কাজ করছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কৃষিবিদ ড. মো. শরফ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন জাতের আমে পরীক্ষামূলকভাবে ফ্রুটব্যাগ ব্যবহারে সুফল পাওয়া গেছে। এটি পরিবেশবান্ধব। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত ও বাণিজ্যিকভাবে আবাদকৃত যেকোনো আমের জাতেই ব্যাগটি ব্যবহার উপযোগী।’ তিনি আরো জানান, আম ছাড়াও মাল্টা, পেয়ারা, ডালিম, কলা, কাঁঠাল, লিচুসহ বিভিন্ন ফলের বাণিজ্যিক চাষে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়। ফ্রুটব্যাগে উৎপাদিত ফল বিষমুক্ত, নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত ও রফতানি উপযোগী। চাষীরা এতে নিঃসন্দেহে লাভবান হবেন।
কৃষিবিদ ড. মো. শরফ উদ্দিন জানান, ৩৫-৪০ দিন বয়সের আমে এ ব্যাগিং করতে হয়। এছাড়া পেয়ারায় ৫০-৫৫ দিনে ও ডালিমে ২০-২৫ দিনে ব্যাগিং করতে হয়। ব্যাগিং করার আগে অবশ্যই কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটের আমচাষী মজিবুর রহমান জানান, তিনি ২০১৫ সালে তার বাগানের বেশকিছু আশ্বিনা আমে ফ্রুটব্যাগিং করেছিলেন। ওই বছর প্রতি মণ সাধারণ আশ্বিনা আম আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। কিন্তু ব্যাগিং করা আম বিক্রি করেন প্রতি মণ ৮-১০ হাজার টাকা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব ও গবেষণাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হামিম রেজা জানান, চাষীরা প্রতি বছর আম সংগ্রহ করার পর পরের মৌসুম পর্যন্ত ১৫-৬২ বার বালাইনাশক ব্যবহার করেন। মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক স্প্রে করা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এটি আমের উৎপাদনকেও ব্যয়বহুল করে তোলে। এছাড়া এতে উপকারী ও বন্ধু পোকাও ধ্বংস হয়। অথচ ফ্রুটব্যাগিং প্রযুক্তির ব্যবহারে বালাইনাশকের ব্যবহার অনেকাংশেই কমে যায়। এছাড়া ফলকে এ পদ্ধতিতে বাইরের আঘাত, পাখির আক্রমণ, প্রখর সূর্যালোক ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে সহজেই রক্ষা করা যায়। এতে আমের গুণগত মান ঠিক থাকে, বাজারে দামও ভালো পাওয়া যায়। ফলে দিন দিন চাষীদের মধ্যে এ পদ্ধতির চাহিদা বাড়ছে।
আর চাষীদের এ চাহিদার কথা চিন্তা করেই এ বছর ফ্রুটব্যাগ উৎপাদন বাড়িয়েছে চাঁপাই অ্যাগ্রো। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান জেসমিন আক্তার জানান, গত বছর তারা প্রচুর চাহিদা সত্ত্বেও ২২ লাখ পিস ফ্রুটব্যাগ উৎপাদন করেন। এ বছর প্রতিদিন গড়ে ৯০ হাজার ফ্রুটব্যাগ উৎপাদিত হচ্ছে। চীন থেকে আমদানিকৃত কাঁচামাল থেকেই এ ব্যাগ তৈরি হচ্ছে। আমদানিকৃত ব্যাগের চেয়ে তাদের উৎপাদিত ব্যাগ গুণগত মানে বেশ এগিয়ে, দামও কিছুটা কম। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে পাঁচজন ডিলার কৃষকদের মাঝে এ ব্যাগ পৌঁছে দিচ্ছেন।
ডিলার পর্যায়ে প্রতিটি ব্যাগের দাম পড়ছে ৩ টাকা, যা উৎপাদন ব্যয়ের সমান। আর সামান্য লাভ রেখে ডিলাররা তা কৃষকদের কাছে বিক্রি করছেন। বর্তমানে বিষমুক্ত ফল ও সবজি উৎপাদনে মাল্টা, কলা, পেয়ারা, বেগুন ও করলার উপযোগী ব্যাগ উৎপাদন প্রক্রিয়া চলছে। এতে এ অঞ্চলের কৃষিতে বিপ্লব ঘটবে বলেও জানান চাঁপাই অ্যাগ্রোর চেয়ারম্যান।
কাঁচামাল আমদানি নিয়ে জটিলতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কৃষি প্রযুক্তিপণ্য হলেও এসব কাঁচামালের শুল্ক অন্যান্য আমদানি পণ্যের মতোই বেশি। ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এছাড়া পণ্য খালাসেও সৃষ্টি হচ্ছে জটিলতা। শুল্কমুক্ত আমদানি ও খালাসে জটিলতা না থাকলে আমচাষীদের আরো সুলভে ফ্রুটব্যাগ পৌঁছে দেয়া সম্ভব।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৫ মে থেকে বাজারে উঠছে গোপালভোগসহ গুটিজাতের আম। আগামী ১ জুন আসবে হিমসাগর, ক্ষীরসাপাত ও লক্ষ্মণভোগ। ১০ জুন আসবে ল্যাংড়া ও বোম্বাই জাতের আম। এছাড়া ২৫ জুন বাজারে উঠবে ফজলি ও ১ জুলাই আম্রপালি। সবশেষে ১৫ জুলাই বাজারে আসবে মৌসুমের শেষ আম আশ্বিনা।
রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের হিসেবে, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছর এ অঞ্চলের ৫৮ হাজার ৯২৪ হেক্টর আম বাগানে ৬ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮৮ টন আম উৎপাদিত হয়েছে। এ বছর বাগানের পরিমাণ বেড়েছে। তাই উৎপাদনও বাড়বে বলে ধারণা করছে কৃষি দপ্তর। বর্তমানে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আম রফতানি হচ্ছে ইংল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি ও সুইডেনে। এ বছর এ অঞ্চল থেকে হাজার টন আম রফতানির সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।