দেশ-বিদেশে সমাদৃত ঝালকাঠির শীতলপাটি

দেশ-বিদেশে সমাদৃত ঝালকাঠির শীতলপাটি। আর এ পাটি তৈরি করেই জীবিকা নির্বাহ করছে জেলার ৩০০ এর বেশি পরিবার। এসব পরিবারের বৃদ্ধ, গৃহবধূ, ছাত্রছাত্রী এমনকি শিশুরাও ব্যস্ত সময় পার করছে এ নিপুণ কারুকাজে। জানা গেছে, পাইত্রা বা মোর্তা নামে এক ধরনের বর্ষজীবী উদ্ভিদের কা- থেকে বেতি তৈরি করা হয়। স্থানীয়ভাবে এসব গাছ পাটি গাছ নামেও পরিচিত। পরিপক্ব পাটি গাছ কেটে পানিতে ভিজিয়ে পাটির বেতি তোলা হয়। এরপর ভাতের মাড় ও পানি মিশিয়ে বেতি সেদ্ধ করা হয়। ফলে বেতি হয়ে ওঠে মসৃণ ও সাদাটে। বেতির উপরের খোলস থেকে শীতল পাটি, পরের অংশ তুলে বুকার পাটি এবং অবশিষ্ট অংশ ছোটার (চিকন দড়ি) তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়।

ঝালকাঠির রাজাপুরের বেশ কয়েকটি গ্রামে বৃদ্ধ, গৃহবধূ, ছাত্রছাত্রী এমনকি শিশুরাও ব্যস্ত এ নিপুণ কারুকাজে। জেলায় ৩০০ এর বেশি পরিবার এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। আর রাজাপুরের দুইটি গ্রামকে ‘শীতল পাটির’ গ্রাম নামেও আখ্যা দেয়া হয়েছে। হাইলাকাঠি ও ডহরশংকর নামে এই দুই গ্রামে রয়েছে ২ শতাধিক পরিবার। এরা সবাই পাটি বুনে জীবিকা নির্বাহ করে। পুরাতন ঐতিহ্যে শীতল পাটির জন্য গ্রাম দুইটিকে ‘শীতল পাটির’ গ্রাম নামে ডাকা হয়। গ্রামের শত শত হেক্টর জমি জুড়ে নজরকাড়া পাটি গাছের বাগান। গ্রামগুলোতে শীতলপাটি, নামাজের পাটি ও আসন পাটি নামে তিন ধরনের পাটি তৈরি করা হয়। পাটির বুনন পদ্ধতি প্রধানত দুই ধরনের। প্রথমত, পাটির জমিনে ‘জো’ তুলে তাতে রঙিন বেতি দিয়ে নকশা তোলা হয়। দ্বিতীয়ত, পাটির জমিন তৈরি হলে তার চারদিকে অন্য রঙের বেতি দিয়ে মুড়ে দেয়া হয়।
এলাকাবাসী জানান, শৈল্পিক উপস্থাপনায় এবং নির্মাণ কুশলতার কারণে দক্ষ ও সুনিপুণ একজন পাটিয়াল নারীর কদর রয়েছে সর্বত্র। একটি পাটি বুনতে ৩ থেকে ৪ জনের ২ থেকে ৩ দিন সময় লাগে, যা বিক্রি করে ৫০০ থেকে দেড় হাজার টাকা আয় হয়। মহাজনরা প্রতি পাটিতে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা লাভ করেন। পাটি শিল্পীরা জানান, পাইত্রা চাষ ও কেনার জন্য প্রচুর মূলধন প্রয়োজন হয়। এ জন্য শিল্পীরা মহাজন ও এনজিওদের কাছে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি হচ্ছে না। শীতলপাটি শিল্পীর জন্য ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা না থাকায় পুঁজির জন্য শিল্পীরা দাদন ব্যবসায়ী, সুদখোর মহাজনদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন। তাছাড়া বিদেশে ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত শীতলপাটি রফতানিযোগ্য পণ্যের স্বীকৃতি পায়নি।
পাটি শিল্পী মঞ্জুরানী বলেন, ‘আমাদের তৈরি শীতলপাটি দেশ-বিদেশে সমাদৃত। দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা ও বাজারে বিক্রি হচ্ছে এ পাটি। বিদেশেও যাচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। শুধু শীতলপাটি বিক্রি করেই সংসারের খরচ এবং ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাই। তবে শীত এবং বর্ষার সময় আর্থিক সংকটে ভুগতে হয় আমাদের। সরকার যদি বিনা সুদে ঋণ প্রদান করত, তাহলে বেশি পরিমাণে পাইত্রা ক্রয় করে শীতলপাটি তৈরি করা সম্ভব হতো।’ ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী মৌসুমি (পাটিকর) জানায়, তাদের পরিবারের সবাই পাটি বুনতে পারে। বাবা-মাকে সহযোগিতা করার জন্য পড়ালেখার পাশাপাশি পাটি তৈরি করি। এতে বাবা-মাও খুশি। স্থানীয় পাটি শিল্পী সমিতির সভাপতি বলাই চন্দ্র পাটিকর বলেন, গরমে একটু প্রশান্তির জন্য যুগ যুগ ধরে দেশের মানুষ শীতলপাটি ব্যবহার করে আসছে। পাটি শিল্পীদের সরকারিভাবে কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসএমই খাতের আওতায় ঋণ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ২৫ জন পাটি শিল্পীকে ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ প্রদান করা হয়। তবে বিনা সুদে ঋণ বিতরণ করলে আমরা উপকৃত হব।
ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক মোঃ হামিদুল হক বলেন, ঝালকাঠির শীতলপাটি দেশজুড়ে বিখ্যাত। চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পাটি বিপণনে ত্রুটি থাকায় বছরের একটা সময় তাদের বসে থাকতে হচ্ছে। সরকারের অতিদরিদ্র্য কর্ম সৃজন কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্র পাটি শিল্পীদের কাজের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।