বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিধারায় বহুমুখী পরিবর্তন এসেছে। আমদানিনির্ভরতা কমে এখন হয়েছে রপ্তানিমুখী। বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্য রক্ষায় আগে বৈদেশিক সহায়তাই বড় ভূমিকা রাখত। এখন সেখানে এগিয়ে এসেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। কৃষিতেও উৎপাদন বেড়েছে ঈর্ষণীয়ভাবে। বড় পুঁজির পাশাপাশি ক্ষুদ্র পুঁজির ব্যবসারও প্রসার ঘটেছে। সব মিলে অর্থনৈতিক কর্মকা- বেড়েছে। এতে বেড়েছে মাথাপিছু গড় আয়। এসব নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন গোলাম রাব্বানী
নানা বাধা-বিপত্তি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক ঝড়ঝঞ্ঝা, আন্তর্জাতিক প্রতিকূলতা, হাজারো রকমের দুর্নীতির পাহাড় অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর যে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছিল, সে দেশকেই এখন অনেক ক্ষেত্রে অনুকরণীয় বলে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। এগিয়েছে দেশের অর্থনীতি। বেড়েছে প্রবৃদ্ধির হার। এর সঙ্গে বেড়েছে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল মাত্র ১২৯ মার্কিন ডলার। চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৬০২ ডলার। এ হিসাবে গত ৪৪ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় বেড়েছে প্রায় ১১ গুণ।
তবে মাথাপিছু আয় বাড়লেও সমাজের মধ্যে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েছে। দরিদ্রশ্রেণি দারিদ্র্যের সীমা থেকে বেরিয়ে এলেও তাদের জীবনযাত্রার মান খুব বেশি একটা বাড়ছে না। এখনো দেশের প্রায় চার কোটি মানুষ অতিদারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে। ফলে সম্পদের সুষম বণ্টন হচ্ছে না। সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে একটি গ্রুপের হাতে। এতে আয় বাড়ার সুফল সব মানুষ পাচ্ছে না। তবে মাথাপিছু আয় বাড়ার কারণে দেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের কাতারে উঠে যাচ্ছে।
এটি করতে হলে বাংলাদেশকে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে। এর মধ্যে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২৪২ ডলারে উন্নীত করতে হবে। বর্তমানে আছে ১ হাজার ৬০২ ডলার। এ খাতে বাংলাদেশ শর্তপূরণে সক্ষম হয়েছে। তবে জাতিসংঘ বা বিশ্বব্যাংক এ হিসাব মানছে না। তারা বলছে, যেহেতু জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার কম, সে কারণে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণও কম হবে। এ নিয়ে বিতর্ক রয়ে গেছে।
মানবসম্পদে বাংলাদেশের সূচক ৬৬তে নামিয় আনতে হবে। বর্তমানে আছে ৭০। শিশু, মাতৃমৃত্যু, দক্ষ মানবসম্পদ ও উৎপাদন-সক্ষমতার ওপর এ সূচক নির্ভর করে।
অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতায় বাংলাদেশের সূচক ৩২-এ উন্নীত করতে হবে। বর্তমানে এটি আছে ২৫ দশমিক ৩-এ। অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলায় সক্ষমতার ভিত্তিতে এ সূচক তৈরি করা হয়। এসব সূচকে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করলেই বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের কাতারে উঠে আসবে। জাতিসংঘের বিধি অনুযায়ী, যেসব দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৪৫ ডলার বা তার নিচে, তাদের বলা হয় নিম্নআয়ের দেশ। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে এ তালিকাতেই ছিল। আর ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে শুরু করে যেসব দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার, তারা মধ্যম আয়ের দেশের অন্তর্ভুক্ত।
এর মধ্যে আবার আয় ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে শুরু করে ৪ হাজার ১২৫ ডলার পর্যন্ত হলে তা হবে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ এবং আয় ৪ হাজার ১২৬ ডলার থেকে শুরু করে ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার হলে দেশগুলোকে বলা হয় উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ। এর চেয়ে বেশি মাথাপিছু জাতীয় আয় হলে সেই দেশগুলোকে বলা হয় উচ্চ আয়ের দেশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য থেকে দেখা যায়, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ১২৯ ডলার হলেও ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় কমে দাঁড়ায় ১২০ ডলার। অর্থনৈতিক মন্দাসহ নানা কারণে ওই বছরে এর পরিমাণ কমে যায়। তবে ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬০ ডলারে। এ বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা চলে ১৯৭৫-৭৬ ও ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে। তখন মাথাপিছু আয় বেড়ে হয় যথাক্রমে ২০০ ও ২১০ ডলার। তবে ১৯৭৭-৭৮ ও ১৯৭৮-৭৯ অর্থবছরে ধারাবাহিকভাবে আয় কমে যায়। ওই দুই অর্থবছরে এ আয় কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১৭০ ও ১৬০ ডলারে। ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় আবার বেড়ে দাঁড়ায় ১৯০ ডলারে। ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে এ আয় আরও বেড়ে দাঁড়ায় ২৩০ ডলারে। ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ২৬০ ডলারে।
মাথাপিছু আয়ে সব সময় ধারাবাহিকতা থাকেনি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক আন্দোলন, আন্তর্জাতিক মন্দাÑ এসব কারণে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ অর্থবছরগুলোয় মাথাপিছু আয়ে ওঠানামা করেছে। এ সময় যথাক্রমে মাথাপিছু আয় হয় ২২০, ২১০, ২২০ ও ২৪০ ডলার। ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৮৯ সালের মাথাপিছু আয় আবার বাড়তে শুরু করে। এ সময় ২৭০, ২৮০, ২৯০ ডলার হয়। আর নব্বইয়ের দশকে এসে মাথাপিছু আয় কিছুটা ধীরগতিতে অগ্রসর হয়। ১৯৯০, ১৯৯১ সালে মাথাপিছু আয় হয় ৩১০ ডলার। আর ১৯৯২, ১৯৯৩, ১৯৯৪ সালে মাথাপিছু আয় ৩২০ ডলারের মধ্যেই আটকে ছিল। তবে ১৯৯৫ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৩০ ডলার হয়। আর ১৯৯৬, ১৯৯৭, ১৯৯৮, ১৯৯৯ সালে ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে মাথাপিছু আয়। যথাক্রমে তখনকার সময়ের মাথাপিছু আয় ৩৬০, ৩৯০, ৪০০, ৪১০ ডলারে দাঁড়ায়।
বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মাথাপিছু আয় যথাক্রমে ৪২০, ৪৩০, ৪২০, ৪৫০, ৪৯০ ও ৫৪০ ডলার হয়। আর ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মাথাপিছু আয় বেড়ে যথাক্রমে ৫৬০, ৫৯০, ৬৫০, ৭১০ ও ৭৮০ ডলারে দাঁড়ায়। তবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের বড় পরিবর্তন শুরু হয় ২০১১ সালে। ওই সময় মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৮৭০ ডলারে। ২০১২ সালে এ আয় বেড়ে ৯৫০ ডলারে উন্নীত হয়। ২০১৩ সালে ১০১০ ডলার ও ২০১৪ সালে মাথাপিছু আয় হয় ১০৮০ ডলার। ২০১৫ সালে মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ১ হাজার ১৯০ ডলারে। সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৬৫ ডলার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর চূড়ান্ত হিসাবে, গত অর্থবছর বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৪৬৫ ডলার। এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ১৩৭ ডলার মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া চলতি বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ২ নির্ধারণ করা হয়েছে।