দেশের কিশোরীদের অনুপ্রেরণা শারমিন

ঝালকাঠি জেলার মেয়ে শারমিন আক্তার। অনেক রঙিন স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠছিল সে। পড়ালেখায় মনযোগী হওয়ায় সবাই তাকে ভালোবাসত। সে পড়াশুনা করে অনেক বড় হতে চেয়েছিল। তার রঙিন স্বপ্নগুলো ডানা মেলতে শুরু করেছিল। হঠাৎ করেই তার সেই সুন্দর স্বপ্নের দিনগুলো দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে শুরু করে। শারমিনের মা গোলনূর মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা না করেই হঠাৎ একদিন বিয়ে ঠিক করে ফেলে প্রতিবেশী স্বপন খলিফার সঙ্গে। স্বপন খলিফার বয়স ৩২ আর শারমিনের বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর। নবম শ্রেণিতে পড়ছিল শারমিন।
গত ২০১৫ সালের আগস্ট মাসের ঘটনা। প্রথমে শারমিন এই বিয়ে না দেয়ার জন্য মাকে অনেক অনুনয়-বিনয় করে। কোনো লাভ হয় না বরং বিয়ের জন্য মায়ের চাপ বাড়তেই থাকে। মা জোর করে বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই পরিস্থিতিতে উপায়ন্ত না দেখে শারমিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু রক্ষা হলো না, ধরা পড়ে যায় সে। বিয়ের সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে তার মা স্বপনের সঙ্গে শারমিনকে একরুমে আটকে রাখে। সেখান থেকেও পালিয়ে যায় শারমিন। এক বান্ধবীর সহযোগিতায় মা এবং প্রতিবেশী স্বপনের বিরুদ্ধে মামলা করে সে। মামলাটি সেসময় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। শারমিনের মা গোলনূর এবং স্বপনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। শারমিনকে তার দাদীর জিম্মায় দেওয়া হয়। নিজেই বাল্যবিয়ে রুখে দেয়া এবং মায়ের অন্যায় আচরণের তীব্র প্রতিবাদের এই ঘটনাটি ব্যপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রচার এবং প্রশাসনের সহযোগিতায় শারমিন আবার পড়াশুনা শুরু করে। থেমে যাওয়া স্বপ্ন আবার জেগে ওঠে। শারমিন এখন পড়ছে ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। বিজয়ী শারমিন ভবিষ্যতে একজন আইনজীবী হতে চায়। সে ক্ষতিকর বাল্যবিয়ে ও জোরপূর্বক বিয়ের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর জন্যই ভবিষ্যতে একজন আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
শারমিন তার অসীম সহসিকতার পুরস্কার হিসেবে জয় করে নিয়েছেন ২০১৭ সালের ‘ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ডড়সবহ ড়ভ ঈড়ঁৎধমব অধিৎফ’। আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রতিবছর বিশ্বের ৬০টি দেশের আনুমানিক ১০০ জন নারীকে এই পদকে ভূষিত করা হয়। ২০০৭ সাল থেকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে এই পুরস্কার প্রদান করে আসছে আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট। শান্তি, ন্যায় বিচার, মানবাধিকার, লিঙ্গ সমতা, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহসী পদক্ষেপ, নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। গত ২৯ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে ফার্স্টলেডি মেলানিয়া ট্রাম্প বাংলাদেশের মেয়ে শারমিনের হাতে তুলে দেন ‘ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ডড়সবহ ড়ভ ঈড়ঁৎধমব অধিৎফ’। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, শারমিন আক্তারকে এই বছর ‘সাহসী নারী’ পুরস্কার দেয়া হলো। মাত্র ১৫ বছর বয়সে নিজের বাল্য বিয়ে ঠেকিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার কিশোরীদের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে শারমিন।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি থমাস শ্যাননের উপস্থাপনায় পরিচালিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রঙ লাল-সবুজ শাড়ি পরে শারমিন পুরস্কার গ্রহণ করে। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ফার্স্টলেডি মেলানিয়া ট্রাম্প বলেন, ‘যখনই নারীর অধিকার খর্ব করা হয়, সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী নিজেও অনেকটা খর্ব হয়ে যায়। আর যখনই পৃথিবীর কোথাও কোনো নারী ক্ষমতায়িত হয়, আমরাও তাদের সঙ্গে শক্তিশালী হয়ে উঠি’। বাংলাদেশের পক্ষে শারমিন আক্তারের আগে আইনজীবী সারা হোসেন এবং একুশে টেলিভিশনের সাংবাদিক নাদিরা শারমীন এ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।
পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে শারমিন বলেন, ‘আমি চাই আমার মতো সবাই এমন সাহস দেখাক। নিজের বাল্যবিয়ে নিজেই বন্ধ করুক। তারা যেন দুর্বল না হয়ে পড়ে, নিজের মধ্যে সাহস রাখে। এই পুরস্কার শুধু আমার নিজের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্জন।’
শারমিন দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েদের জন্য আজ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দক্ষিণ এশিয়ায় বাল্যবিয়ের হার অত্যন্ত বেশি। সেইসঙ্গে বাল্যবিয়ে বাংলাদেশের অবস্থানও অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে। বাল্যবিয়ে কিশোরীর স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও শিক্ষার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অল্প বয়সে মা হতে গিয়ে অনেক সময় তা কিশোরীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মা ও শিশু মৃত্যুর হার বৃদ্ধি করে। শারমিন নিজের বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে যে সাহসী প্রতিবাদ ও অসাধারণ আত্মবিশ্বাস দেখিয়েছে তা বাল্যবিয়ে রোধে অন্য কিশোরীদেরও অনুপ্রাণিত করবে। এর ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক মেয়ের কাছেই শারমিন হয়ে উঠতে পারে অনুকরণীয়।
বাংলাদেশে শারমিনের মত অনেক মেয়েই এখন সাহসী হয়ে উঠছে, বাল্যবিয়ে ঠেকাচ্ছে। তবে সমাজ থেকে লিঙ্গ- বৈষম্য দূর করা না গেলে সহাসী পদক্ষেপ খুব বেশি কাজে আসবে না। এজন্য প্রতিটি বাবা-মা এবং অভিভাবকের দৃষ্টিভঙ্গীর পরির্তন প্রয়োজন। তাদের প্রচেষ্টা থাকতে হবে যাতে, প্রতিটি মেয়েই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। কর্মক্ষম হতে পারে। আর তা করতে পারলে পরবর্তীতে যে কোন বিপদ থেকে তারা নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করতে পারবে।
কন্যাসন্তানকে অবহেলা না করা বা শুধু মেয়ে বলেই বৈষম্য না করে নিজের কন্যাসন্তানটিকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখতে হবে। তার মধ্যে যে অফুরন্ত সম্ভবনা লুকিয়ে আছে সেগুলো বিকশিত হতে সাহায্য করতে হবে। পরিবার থেকেই তার মতামতের প্রতি সম্মান, ভালোবাসা এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে লড়াই করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
সুস্থ, সবল জাতি গঠনে বাল্যবিয়ে বন্ধের বিকল্প নেই। সরকার বাল্যবিয়ে বন্ধে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন ২০১৭ প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি সামাজিকভাবেও বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। এর ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে বেশি করে গণমাধ্যমে প্রচার করতে হবে। অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সব মেয়েরা প্রতিবাদী হলে বাল্যবিয়ে অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে।