মধু’র অর্থনীতি উজ্জ্বল সম্ভাবনা

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে প্রায় প্রত্যেক ঋতুতে কোনো না কোনো ফুল ফোটে। আর এসব ফুল থেকে মধু আহরণের বিরাট সুযোগ রয়েছে। এ কারণে মৌ চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী আমাদের বাংলাদেশ। একটা সময় মধু আহরণ ছিল শুধুমাত্র সুন্দরবন কেন্দ্রিক। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে মধু উত্পাদন, ব্যবহার বেড়েছে বহুগুণে। এখন মধু চাষ হয় ব্যাপকভাবে। দেশে মধুর উত্পাদন ও বহুমাত্রিক ব্যবহার বেড়েছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে মধু এখন রফতানি পণ্য তালিকায় নাম লিখিয়েছে। দেশে বর্তমানে দুই প্রজাতির মৌমাছির দিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌ-বাক্সে চাষ করা হয়। মৌ-চাষ বিশেষজ্ঞ ও কৃষি গবেষকদের মতে, ফসলের মাঠে মৌমাছি বিচরণ করলে সেখানে বাড়তি পরাগায়ণের কারণে ফসলের উত্পাদন ৩০ শতাংশ বাড়বে। তার মানে মৌচাষের মাধ্যমে মধু আহরণে লাভ দুটি- ১. অর্থকরি খাত হিসেবে মধু আহরণে সমৃদ্ধি, ২. শষ্য বা মধুভিত্তিক কৃষিজ উত্পাদন বৃদ্ধি। সুন্দরবনের পাশাপাশি পেশাদার মৌ-চাষিরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মৌসুমে সরিষা, ধনিয়া, তিল, কালিজিরা, লিচু এসব ফসলের জমিতে বা বাগানে মৌ বাক্স বসিয়ে মধু আহরণ করে। আধুনিক পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে মৌ চাষ করে শত শত মেট্রিক টন মধু উত্পাদন করা হচ্ছে। এর ফলে মধু আহরিত শস্য যেমন সরিষা, তিল, কালিজিরা, লিচু ইত্যাদিও ফলনও বেড়েছে অনেক গুণ। মৌচাষিরা বিভিন্ন ঋতুতে তাদের মৌবাক্সে নিয়ে গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, শেরপুর, সাভার, দিনাজপুর, রাজশাহী, বরগুনা ও সুন্দরবনের সাতক্ষীরায় মধু সংগ্রহে চলে যান। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেখানে তারা অবস্থান করেন এবং মধু সংগ্রহ করে ফিরে আসেন। সংগ্রহকারীর কেউ কেউ স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে মধু বিক্রি করেন। বড় খামারিরা সংগৃহীত মধু প্রসেসিং প্ল্যান্টে পরিশোধন করে বাজারজাত করেন। সরিষা, লিচু, তিল ও কালিজিরা ফুল থেকে সংগৃহীত মধু আলাদা আলাদাভাবে বাজারজাত করছেন ব্যবসায়ীরা। এমন বিভিন্ন ধরনের মধু উত্পাদন একমাত্র বাংলাদেশেই সম্ভব।

বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশে মধু উত্পাদনে সরাসরি জড়িত প্রায় ১৮ হাজার মৌ-চাষিসহ মধু শিল্পে জড়িত প্রায় ২ লাখ মানুষ। উত্পাদন প্রায় ৬ হাজার টন। কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদফতরের হিসাবে, বাংলাদেশে ৬ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়। ২০ হাজার হেক্টর জমিতে কালিজিরা, ৪৮ হাজার হেক্টর জমিতে ধনিয়া, ২০ হাজার হেক্টর জমিতে তিল ও বিপুল পরিমাণ জমিতে লিচু উত্পাদিত হয়। এ পুরো সেক্টরটিকে মধু আহরণের আওতায় আনতে পারলে ফসলের উত্পাদন দ্বিগুণেরও বেশি হবে বলে অনেকের ধারণা। দেশে এখন প্রায় সাড়ে ছয় লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়। তার মাত্র ১০ শতাংশ থেকে এখন মধু সংগ্রহ করা যাচ্ছে। পুরো সরিষার মাঠ মধু সংগ্রহের আওতায় আনা গেলে উত্পাদন অনেক বাড়ানো সম্ভব। তবে আশার খবর হলো, লক্ষ্য বাস্তবায়নে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিসিকের আওতায় মৌ-চাষ সংক্রান্ত মধু উত্পাদন ও বাজারজাতকরণ বিষয়ক একটি প্রকল্প মৌ-চাষিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মান সম্পন্ন মৌ বাক্স সরবরাহ করে।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৫৫০ মেট্রিক টন বা ৫৫ কোটি টাকার মধু ভারত, আরব আমিরাত ও অন্যান্য দেশে রপ্তানি হয়েছে। জানা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি মধু রপ্তানি হয়। বিশ্বের বৃহত্তম মধু রপ্তানিকারক দেশটির নাম চীন। মধু রপ্তানিকারক অন্যান্য দেশগুলো-আর্জেন্টিনা, নিউজিল্যান্ড, মেক্সিকো। সবচেয়ে বেশি মধু আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জাপান। নতুন বাজার সৃষ্টি হওয়ায় বাংলাদেশের মধু এখন বিশ্বের বেশ কিছু দেশে রফতানি হচ্ছে। আমাদের দেশের মধুর গুণগত মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের।

কৃষি ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানের গবেষণা অনুযায়ী, উদ্ভিদের পরাগায়নে মৌমাছির গুরুত্ব অপরিসীম। মৌমাছির মাধ্যমে বাক্স পদ্ধতিতে মধু চাষের কারণে কৃষিখাতে উত্পাদন ১০ থেকে ২০ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব বলে গবেষণায় জানানো হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে বাংলাদেশের কৃষকদের ধারণা স্পষ্ট নয়। তাই মধুভিত্তিক শস্য সরিষা, তিল, তিষি, লিচু ইত্যাদির কৃষিজ উত্পাদন বাড়াতে মৌ-চাষ এবং মৌ-চাষের উপকারিতা সম্পর্কে স্থানীয় কৃষি অফিস ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে ব্যাপক প্রচারণা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা জরুরি।

আশার খবর হচ্ছে- সরকার ২০১২-১৭ মেয়াদে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় মৌ-চাষ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ এবং মৌ-চাষিদের বিসিক থেকে সহজ শর্তে ৯ শতাংশ সরল সুদে ঋণ দেয়া হচ্ছে। উত্পাদিত মধুর জনপ্রিয়তা বাড়াতে বিসিক বিভিন্ন সময় মেলার আয়োজন করছে। মৌ বিশেষজ্ঞদের অভিমত, মৌচাষে উন্নতি প্রযুক্তির প্রয়োগ, চাষিদের প্রশিক্ষণ, সহজ শর্তে ঋণ এবং একই সাথে মৌ-চাষির সংখ্যা বাড়ালে বছরে এক লাখ মেট্রিক টন মধু উত্পাদন করা এবং বিপুল পরিমাণ মধু বিদেশে রফতানি করা সম্ভব।