প্রবাসী আয় বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এবার বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের নিয়ে আর্থিক শিক্ষা ও রেমিট্যান্সবিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) মপযছ বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সহযোগিতায় এসব কর্মশালার আয়োজন করা হচ্ছে। এতে দেশের সব তফসিলি ব্যাংকের কর্মকর্তারাও অংশ নেবেন। বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের অ্যাকাউন্ট খোলা নিশ্চিতকরণ ও তাদের কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগে আনা হলো এসব কর্মশালার মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, এর মাধ্যমে হুন্ডি প্রবণতা রোধ, বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ ও ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণ উৎসাহিত হবে। এ উদ্যোগের ফলে আগামীতে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে এবং এর মাধ্যমে অর্থনীতির ভিত আরও শক্তিশালী হবে।
চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহে নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নানা পদক্ষেপেও প্রবাসী আয়ে মন্দা কাটছে না। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। এছাড়া একক মাস হিসেবে এপ্রিলে প্রবাসী আয় কমেছে প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হলোÑ অবৈধ পথে (হুন্ডি) রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা বৃদ্ধি। এক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যবহার হওয়ার প্রমাণও মিলেছে। এছাড়া কর্মশালায়ও রেমিট্যান্স কমার কারণ হিসেবে হুন্ডিকে দায়ী করা হয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশে কর্মদিবস ও ছুটির দিন একই হওয়ায় সেখানকার বাংলাদেশীরা হুন্ডির দ্বারস্থ হতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানা গেছে। কারণ কর্মব্যস্ত দিনগুলোতে কর্মীরা ব্যাংকে যেতে পারেন না। ছুটির দিনে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও সেখানে সাপ্তাহিক ছুটির কারণে বাংলাদেশী ব্যাংকের শাখাও বন্ধ থাকে।
ধারাবাহিকভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমার কারণ অনুসন্ধান ও প্রতিকারে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে অর্থ, পররাষ্ট্র, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক। কয়েক দফায় রেমিট্যান্স আহরণকারী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে আর্থিক খাতের অভিভাবক বাংলাদেশ ব্যাংক। এমনকি মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রদানকারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বিকাশের সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুত হওয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশীরা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠাচ্ছেন। এতে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে হুন্ডির তৎপরতা বেড়ে গেছে। এ কারণে হুন্ডির দেশি-বিদেশি চক্র ভাঙতে কাজ করছে সরকারের একাধিক সংস্থা। এরই অংশ হিসেবে বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের ব্যাংকিং হিসাব খোলা নিশ্চিতকরণ ও তাদের কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগে আনতে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ হিসেবে বিভিন্ন বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আর্থিক শিক্ষা ও রেমিট্যান্স প্রবাহ শীর্ষক কর্মশালার আয়োজন করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন বিভাগ। এরই মধ্যে সিলেট, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। আগামীতে নোয়াখালী, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল, মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকায় কর্মশালা আয়োজনের চিন্তা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মিজানুর রহমান জোয়াদ্দার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, প্রবাসী আয় বাড়াতে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার ও দেশে বিনিয়োগে বিদেশ গমনেচ্ছুদের উৎসাহিতকরণ এবং হুন্ডি প্রবণতা রোধে এসব কর্মশালার আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে বিদেশ গমনেচ্ছুদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা দেয়ার পাশাপাশি তাদের ব্যাংক হিসাব খোলার বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। শুধু তাই নয়, রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে আনতে কর্মীর নিজ নামে অ্যাকাউন্ট খোলার পাশাপাশি তার পরিবারের সঙ্গেও যৌথ অ্যাকাউন্ট খোলার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এছাড়া আর্থিক শিক্ষার মাধ্যমে দেশে তাদের বিনিয়োগে উৎসাহিত তথা বৈদেশিক মুদ্রার বিভিন্ন বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ সুবিধা সম্পর্কেও ধারণা দেয়া হচ্ছে।
সূত্র জানায়, সর্বশেষ চলতি বছরের ৬ এপ্রিল কুমিল্লায় বিএমইটির প্রশিক্ষণ ব্যুরো ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক কার্যালয়ে কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মোঃ আবুল বশর। কর্মশালায় কুমিল্লা অঞ্চলের সব তফসিলি ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক ও শাখা প্রধান, বিএমইটির প্রশিক্ষক ও বিদেশ গমনেচ্ছু ২০ জন উপস্থিত ছিলেন। জানা গেছে, ওই কর্মশালায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আর্থিক শিক্ষা ও প্রবাসীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে সুযোগ-সুবিধাবিষয়ক একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করা হয়। এর মাধ্যমে বিদেশ গমনেচ্ছুরা বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর গুরুত্ব ও প্রবাসীদের জন্য দেশে বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে জানতে পারেন।
এছাড়া কর্মশালায় প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত এবং তা উত্তরণে বেশকিছু সুপারিশ ও মতামত উঠে আসে। এগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ বিএমইটি ও বাংলাদেশ ব্যাংক সম্মিলিতভাবে সারা দেশে বিএমইটির ৫৩টি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে বিদেশ গমনেচ্ছুদের মাঝে আর্থিক শিক্ষা ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বিষয়ে প্রচার চালানো, যেসব অঞ্চলে বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখা নেই সেসব অঞ্চলে তফসিলি ব্যাংকগুলো বিএমইটি ও বায়রার সহযোগিতায় কর্মশালার আয়োজন, কর্মীদের বিদেশ পাঠানোর আগে প্রাক-বহির্গমনের সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা উপস্থিত হয়ে তাদের অ্যাকাউন্ট খোলা নিশ্চিতকরণ, বিএমইটি থেকে বিদেশগামী কর্মীদের বহুমুখী ব্যবহারের জন্য প্রদত্ত স্মার্ট কার্ড ব্যাংকিং সিস্টেমের সঙ্গে একীভূত করা- যাতে হিসাব খোলা ও রেমিট্যান্স পাঠানো সহজ হয়, কর্মীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর সুবিধার্থে মধ্যপ্রাচ্যে শুক্র ও শনিবার ব্যাংকের শাখা খোলা রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা, বিনা খরচে (প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে) রেমিট্যান্স পাঠানোর সুবিধা প্রদান ও রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত করতে ব্যাংকের ফি তথা কমিশন হ্রাস করার উদ্যোগ গ্রহণ, বিদেশ গমনেচ্ছুদের আর্থিক সুবিধা তথা ঋণ সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা করা ও দেশে ফেরার পর প্রবাসীদের কর্মদক্ষতা অনুযায়ী ঋণ সুবিধা দেয়ার সুপারিশ করা হয়।
সুপারিশের মধ্যে রয়েছেÑ বিদেশ গমনেচ্ছুদের অ্যাকাউন্ট খোলা, তাদের স্মার্ট কার্ড ব্যাংকিং সিস্টেমের সঙ্গে একীভূত করা এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানকে উৎসাহিত করতে বিদেশ গমনেচ্ছুদের ব্যাংক ঋণ সহজ করা ও দেশে ফেরার পর তাদের কর্মদক্ষতা অনুযায়ী ঋণ সুবিধা প্রদানের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।