দেশের ৮০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করেও বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে বগুড়ার ফাউন্ড্রি ও ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রাংশ। ভারত, নেপাল ও ভুটানে স্থান করে নিয়েছে এসব কৃষি ও সেচযন্ত্র। গুণগতমান ও দামে সহজলভ্য হওয়ায় অবাদে দেশের বাইরে যাচ্ছে এসব শিল্পপণ্য। প্রতিবছর এ খাতে বেচাকেনা হয় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের অর্থনীতিকে বেগমান রাখতে বড় ভূমিকা রাখছে।
বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও এসব ওয়ার্কশপগুলোর চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট জায়গা, পুঁজি সংকট, আধুনিক মেশিন, ব্যাংক ঋণ, শ্রমিকদের যথাযথ ট্রেনিংসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অভাব রয়েছে। তবে সল্প পরিসরে এ শিল্পের উন্নয়নের জন্য এসএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প) ফাউন্ডেশন এখানকার শ্রমিকদের ট্রেনিং ও ঋণ সহযোগিতা প্রদান করছে। এতে তাদের বাণিজ্যিক ঝুঁকি কমেছে, বেড়েছে ব্যবসার প্রসার। তবে অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের প্রতি এ ঋণের সহযোগিতা বাড়ানোর আহ্বান জানান সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি বগুড়ার বিভিন্ন ফাউন্ড্রি ও রেলওয়ে মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, ভাঙা জাহাজের লোহা-লক্কড়সহ পরিত্যক্ত লোহা গলিয়ে এসব কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরি হয়। এখানে এ ধরনের ফাউন্ড্রি শিল্প রয়েছে প্রায় ৫২-৫৫টি। এ ছাড়া বিভিন্ন ছোট, বড় ও মাঝারি ধরনের কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ও ওয়ার্কশপ রয়েছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০টি। এসব কারখানায় তৈরি যন্ত্রাংশের মধ্যে রয়েছে পানির পাম্প, টিউবওয়েল, সেন্টিফিউগাল পাম্প, লাইনার, পিস্টন, শ্যালো ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ, সাইকেল, রিকশা-পার্টস, পাওয়ার টিলারের চাকা, ফলা, ট্রলি, ধান ভাঙা ও ভুট্টা মাড়াই এবং আখ মাড়াইয়ের মেশিনসহ প্রায় সব কৃষি উপকরণাদি।
এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বর্তমানে এ শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ২ লাখ মানুষের। এ শিল্পকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন একটি নির্দিষ্ট প্রসেসিং জোন বা স্থায়ী শিল্প এলাকা, স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ, দক্ষ শ্রমিক, আধুনিক যন্ত্রাংশ, চাহিদামতো কাঁচামাল ও গ্যাসের সরবরাহ। পাশাপাশি বিদেশ থেকে ফিনিশ পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত করাসহ দেশি পণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে ট্যাক্স কমালে এ শিল্পে বিপ্লব ঘটবে। কারণ এখানে তৈরি এসব যন্ত্রপাতির মান চীন ও জাপানের যন্ত্রপাতির চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। সরকার একটু নজর দিলে রপ্তানি বাজারে বিশাল অবদান রাখতে সক্ষম এ শিল্পখাত। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে এসব কারখানা ও ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ। তারা আরো বলেন, দেশের প্রত্যন্ত এলাকার ক্রেতারা এখান থেকে কৃষি যন্ত্রাংশ কিনে নিয়ে যায়। কৃষিভিত্তিক শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও নানান সমস্যার কারণে তা দ্রুত অগ্রসর হতে পারছে না। এ শিল্পে ব্যাংক ঋণ বা সরকারি সহযোগিতার পরিমাণ খুবই কম। শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণেরও অভাব রয়েছে। যন্ত্রপাতি তৈরিতে আধুনিক মেশিনারি পেলে এবং কারিগরদের প্রশিক্ষণ দেয়া গেলে এ শিল্প অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, ক্ষুদ্র মেশিনারি শিল্পকে ঘিরে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে গড়ে উঠেছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বিশাল বাজার। স্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উদ্যোগেই বগুড়ায় এ শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। এ কারণে বগুড়াকে কৃষি যন্ত্রাংশ উৎপাদন জোন ঘোষণারও দাবি জানিয়েছেন। তারা আরও বলেন, গত কয়েক দশকে বগুড়া অঞ্চলে গড়ে উঠেছে কৃষি যন্ত্রাংশ উৎপাদনের প্রায় দেড় হাজার প্রতিষ্ঠান। দেশের কৃষি যন্ত্রাংশের মোট চাহিদার ৮০-৯০ শতাংশেরও বেশি জোগান দিচ্ছে এসব ওয়ার্কশপ। এক সময় চীন, জাপান, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের কৃষি যন্ত্রাংশ এ দেশের বাজার দখল করে থাকলেও একটু একটু করে বগুড়ায় তৈরি যন্ত্রাংশ সেই স্থান পূরণ করছে। এতে একদিকে বিদেশি মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। অন্যদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
এ প্রসঙ্গে ফোরাম অফ এগ্রো মেশিনারিজ ম্যানুফ্যাকচারিং এন্ড প্রসেসিং জোন, বগুড়ার সভাপতি গোলাম আজম টিকুল ভোরের কাগজকে বলেন, বগুড়ার কাস্টার দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে বিপ্লব এনে দিয়েছে। আমরা দেশের মোট চাহিদার শতকরা ৮০ ভাগ কৃষি উপকরণ এখানে তৈরি হলেও এ শিল্প অবহেলিত। সারা বগুড়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এ শিল্প। তাদের দাবি, নির্দিষ্ট একটি জোন না থাকলে কখনোই এ শিল্পের বিকাশ সম্ভব নয়। এ জন্য বগুড়া বিসিক এলাকা সম্প্রসারণ করে কৃষিভিত্তিক শিল্পকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্লট বরাদ্দ দেয়ার দাবি জানান তিনি। এ শিল্প অবহেলিত উল্লেখ করে জনৈক ব্যবসায়ী বলেন, আমাদের কারখানায় লোহার যন্ত্রাংশ তৈরি করা হলেও মেটালকে ট্রিটমেন্ট করা হয় না বলে অনেক উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে অপূর্ণতা থেকে যায়। হিট ট্রিটমেন্টের অভাবে তার সঠিক স্থায়িত্ব থাকে না। তাই বগুড়ায় একটি হিট ট্রিটমেন্ট অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি এ খাতের জন্য ৫ শতাংশ হারে ঋণ দেয়ার দাবি জানান। তাহলে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং কাস্টার তৈরি করা সম্ভব হবে।
বগুড়া ফাউন্ড্রি ওর্নাস এসোসিয়েশনের সভাপতি আজিজার রহমান মিলটন ভোরের কাগজকে বলেন, ফাউন্ড্রি শিল্প হচ্ছে কলকারখানা বাণিজ্যের প্রধান শিল্প। এ শিল্প থেকে উৎপাদিত প্রতিটি পণ্য কৃষির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তাছাড়া দেশের জুট মিলস ও বিভিন্ন বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশের বড় একটা অংশ পূরণ করে থাকে ফাউন্ড্রি শিল্প। অথচ এখনো সনাতন পদ্ধতিতে পণ্য তৈরি হচ্ছে। এ শিল্পের প্রধান সমস্যা হচ্ছে কাঁচামাল সংগ্রহ, দক্ষ শ্রমিকের অভাব ও শিল্পের আধুনিকায়ন করা।
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামাল মিয়া বলেন, এ শিল্প রক্ষায় সরকারকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকার আমাদের কিছু প্রণোদনা দিয়েছে। এ প্রণোদনার হার বাড়াতে হবে। এসএমই ফাউন্ডেশন আমাদের ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিয়েছে। এর সুদের হার আরো কমাতে হবে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, দেশে কর্মসংস্থান তৈরি করতে হলে এসএমই শিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। তাহলে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গার পাশাপশি কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এ খাতে বিনিয়োগ কম হলেও উপকার ভোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এসএমই ফাউন্ডেশন পুঁজির অভাবে কাজ করতে পারছে না। এ জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই আমরা আরো বেশি করে ফান্ড পাব। তিনি বলেন, বগুড়া জেলার লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং এসএমই ক্লাস্টার উন্নয়নে মাইডাস ফাইন্যান্সের মাধ্যমে সহজ শর্তে এবং স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করছে। ক্লাস্টারটির উন্নয়নে বর্তমানে ফাউন্ডেশন বিভিন্ন মেয়াদি কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যেমন জ্বালানি সাশ্রয়ী উৎপাদন-বিষয়ক সহায়তা, নতুন পণ্য উৎপাদনে প্রযুক্তিগত সহায়তা, নতুন পণ্য উৎপাদনের সম্ভাব্যতা যাচাই, উদ্যোক্তাদের দেশ-বিদেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মেলায় অংশগ্রহণে সহায়তা প্রদান। ফাউন্ডেশন বর্তমানে এ শিল্পের শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের ইনপ্ল্যান্ট প্রশিক্ষণ প্রদান করছে।