নানা উদ্যোগের পরও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঝরে পড়ছে ১৭ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী। এ অবস্থায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচি নতুন করে বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার। এজন্য প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে স্কুল ফিডিং নীতিমালা। এর আওতায় দেশের ৬৩ হাজারের বেশি স্কুলে শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে খাবার পাবে। একই সঙ্গে খাবারের অবকাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব শিশুকে স্কুলে ভর্তি, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার বাড়ানো, পাঠে মনোনিবেশ, ঝরে পড়া বন্ধ, শিশুর পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে স্বাস্থ্যবান, সবল, সক্ষম, মেধাবী জাতি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য জাতীয় স্কুল ফিডিং নীতিমালা-২০১৭ এর খসড়া চুড়ান্ত করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ নীতিমালার অধীনে সরকার, বেসরকারি, দাতাসংস্থা, এনজিও, বিত্তশালীদের সহায়তায় ২০২১ সালের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের সব শিশুর জন্য দুপুরের খাবার নিশ্চিত করা হবে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ১৭ শতাংশের কিছু কম। তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, এ হার ২০ শতাংশের বেশি। সারাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৬৩ হাজার ৬০১টি। আর এতে পড়াশোনা করছেন প্রায় দুই কোটি ২০ লাখ শিক্ষার্থী।
ডিপিও সূত্র বলছে, ২০১১ সাল থেকে দেশের ৯৩টি উপজেলায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচি চালু রয়েছে। ৩০ লাখ শিশু এ কর্মসূচির সুফলভোগী। বর্তমানে জনপ্রতি বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত পুষ্টিকর ৭৫ গ্রাম বিস্কুট সরবরাহ করা হচ্ছে। সময়ে সময়ে বিস্কুটের স্বাদ পরিবর্তন করা হচ্ছে। এছাড়া ২০১৩ সালের মাঝামাঝিতে প্রকল্পের আওতায় দেশের কিছু কিছু বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিস্কুটের পরিবর্তে পরীক্ষামূলকভাবে রান্না করা খাবার (মিড ডে মিল) পরিবেশন করা হচ্ছে।
প্রস্তাবিত ফিডিং কর্মসূচির দুপুরের খাবারের আওতায় আছে রান্না করা খাবার (ভাত, খিচুড়ি, ডিম, ডাল, সবজি), প্রতিদিন স্কুল চলাকালে প্রতিটি শিশুকে উপযুক্ত পরিমাণ পুষ্টিকর বিস্কুট, পাউরুটি, শুকনো ফল, দুধ, মৌসুমি ফল দেয়া হবে। এছাড়া যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত খাদ্য দেয়া যাবে। খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও সংগঠনকে প্রাধান্য দেয়া হবে। খাবার দেয়ার ক্ষেত্রে দেশীয় মূল্যবোধ ও খাদ্য-সংস্কৃতি সংরক্ষণপূর্বক সঠিক পুষ্টিমান নিশ্চিত করতে তাগিদ দিয়ে খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, ভৌগোলিক বাস্তবতা ও মৌসুমকে প্রাধান্য দিতে হবে। খাবারের স্বাদ ও রুচি বিবেচনায় সাপ্তাহিক ভিত্তিতে খাদ্য তালিকা প্রস্তত করতে হবে। এক্ষেত্রে কয়েকটি খাদ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
কর্মসূচি বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তা, সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন পরিষদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কমিটি, প্রধান শিক্ষক, শিক্ষক প্রতিনিধি, স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং এনজিও প্রতিনিধি খাদ্য কর্মসূচির প্রয়োজনীয় সমন্বয় ও সহযোগিতা করবেন। কর্মসূচির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য প্রকল্প প্রধান/সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রতি অর্থবছরের কার্যাবলির বিবরণ সংবলিত প্রতিবেদন অর্থবছর শেষ হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে প্রণয়ন করতে হবে। সিটিজেন চার্টার হিসেবে তা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা নিয়ে অনেক দিন ধরে কাজ চলছিল এবং নীতিমালার বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত দিয়েছে। সেগুলো এখন কম্পাইল করার কাজ চলছে। সব স্কুলে সবার জন্য খাবার সংগ্রহকরা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সরকারি-বেসরকারি, এনজিও ও সমাজের বিত্তবানদের সহায়তার স্কুল ফিডিং কর্মসূচি সারা দেশে বাস্তবায়ন করার জন্য নীতিমালাটি করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, সব স্কুলে রান্না না করে একটি ক্লাস্টারে রান্না করে বিতরণের জন্য এনজিওদের দায়িত্ব দেয়ার বিষয়টি চিন্তাভাবনা চলছে। স্থানীয় কমিউনিটিকে এ কাজে সম্পৃক্ত করা হবে। আর্থিক সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় ধাপে ধাপে ২০২১ সালের মধ্যে কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি করে সর্বজনীন করা হবে।
খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, কর্মসূচির আওতা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে খাদ্য ঘাটতি এলাকাসহ আর্থ-সামাজিক ও ভৌগোলিক কারণে অনগ্রসর (হাওর, দুর্গমচর, উপকূলীয় অঞ্চল, পার্বত্য এলাকা, চা বাগানসহ সব পিছিয়ে পড়া) এলাকাকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। সরকারের বার্ষিক বরাদ্দ ও অন্যান্য সূত্র থেকে সংগৃহীত অর্থ কর্মসূচির অর্থের প্রধান উৎস হবে। এছাড়া দুর্গম ও প্রকল্প এলাকায় সরকারি ও বেসরকারি স্কুলের মতো কর্মসূচি পরিচালনার জন্য এনজিওদের উৎসাহিত করা হবে। কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে একটি সেল বা ইউনিট গঠন করা হবে। প্রয়োজনে মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি পৃথক জাতীয় বিদ্যালয়ভিত্তিক খাদ্য কর্মসূচি কর্তৃপক্ষ গঠন করতে পারবে। কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয় বিশ্বখাদ্য কর্মসূচির সহায়তায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র গঠন করবে। এক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ উন্নয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে সংযুক্তির কথা বলা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান কর্মসূচির গবেষণা ও কারিগরি সহযোগিতা প্রদান করবে। এছাড়া কর্মসূচির অর্থায়ন, সম্পদের যথাযথ ব্যবহার, কর্মসূচির গুণগতমান রক্ষা, উদ্ভাবনী কর্মপদ্ধতি পরীক্ষা, পাইলটিং এবং কারিগরি সহায়তা দিবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত দৈনিক ন্যূনতম পুষ্টিমান নিশ্চিতকরণ ও খাবারের পুষ্টিমান নির্ধারণের জন্য কেন্দ্রীয় বিভাগ, জেলা পর্যায়ে পুষ্টিবিদদের এ কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে হবে। খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি কমিটি গঠন করা হবে। তারা খাদ্য প্রস্তুত ও সরবরাহের প্রমিত কৌশল নির্ধারণ করবে।