একা শেখ হাসিনা বনাম জনগণের শেখ হাসিনা

বর্তমানে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য এবং ইতিহাস আমাদের সবার কাছেই জানা। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাদের দলের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পূর্ববর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দলের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস যতদিন লেখা হবে ততদিন এই দলের নাম আসবেই। এই ঐতিহ্যবাহী দলের প্রধানের দায়িত্বে আছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পূর্ববর্তী শাসনামলের চেয়ে বর্তমানে আমরা এক পরিবর্তিত শেখ হাসিনাকেই দেখতে পাচ্ছি। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দেশ পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় তিনি ইতোমধ্যেই দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা দেশের প্রতি তার ভালোবাসা, কমিটম্যান্টের জায়গা সম্পর্কে এই মুহূর্তে কেউ প্রশ্ন তোলার সুযোগ পাচ্ছেন না। এমনকি চিরকালের বিরোধী দল বিএনপির নেতারাও যেসব সমালোচনা করছেন সেগুলোর আসলেই কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি বা জনভিত্তি নেই- এ কথা একদম প্রমাণিত। দেশ-বিদেশে আজকে তার নেতৃত্বেকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে।

এ তো গেল একজন দেশনেতা শেখ হাসিনার কথা। কিন্তু তিনি আরেকটি পরিচয়ে পরিচিত আর সেটা হচ্ছে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগেরও সভাপতি। একটি বৃহত্তর দলের সভাপতি হিসেবে তার ওপর রয়েছে পাহাড় সমান দায়িত্ব। কথা হচ্ছে এই দায়িত্ব কি তিনি একাই পালন করবেন? তাহলে আর কমিটি করে দেয়া কেন? সাধারণ সম্পাদক, সহ-সভাপতি, সাংগঠনিক সম্পাদক, সাহিত্য সম্পাদক, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক এমন অনেক বাহারি নামের পদের সমাহার আছে। দলের কমিটি গঠনের সময় এসব পদের প্রার্থিতা নিয়ে চলতে থাকে নানা দেন-দরবার, নিজেকে প্রমাণ করতেও প্রার্থীরা সোচ্চার থাকেন। নিজেদের যোগ্যতাকে প্রমাণ করতে বড় বড় বুলিও ছাড়েন। আমরা সবাই জানি, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদটির একটি বিশাল গুরুত্ব রয়েছে। সেটি রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণেই আছে। দলের সভাপতি যখন দেশের দায়িত্বে থাকেন তখন সাধারণ সম্পাদককেই দলের সভাপতির ছায়া হিসেবে কাজ করতে হয়। একটি বড় দলের নেতাদের কাছে প্রত্যাশা থাকে অনেক। বিশেষ করে দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখন দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়। একদিকে দলের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা, দলের ভাবমূর্তি নষ্ট না হয় সে বিষয়ে সতর্ক রাখা এবং সারাদেশে সরকারের কার্যক্রমের সাফল্যের বার্তাকে কীভাবে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া যায় সে বিষয়েও ভূমিকা রাখাটা দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।

বাস্তবে আমরা কী দেখি? কোথাও কী তাদের কর্মসূচি দেখি যেখানে সারাদেশে নতুন নতুন নেতাকর্মী গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত? সম্প্রতি সাধারণ সম্পাদকের কিছু বক্তব্যে তৈরি হয়েছে একধরনের কৌতুকের পরিবেশ। একজন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং যিনি সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও আছেন তার কাছে আমরা আরো গঠনমূলক এবং দায়িত্বশীল বক্তব্য ও আচরণ আশা করি। তার টার্গেট যদি থাকে মিডিয়া হাইলাইট তাহলে বলব, তিনি শতভাগ সফল হতে পারেননি। কারণ তিনি সামনে এসেছেন সমালোচিত হয়ে, আলোচিত হয়েছেন বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে। একদিকে শেখ হাসিনা বলে যাচ্ছেন দেশের কাজে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কাজ করতে হবে, ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে চিন্তা করতে হবে। দলকে শক্তিশালী করতে হবে, বেশি করে পড়াশোনা করে নিজেদের শিক্ষিত করতে হবে। দলে যেন কোনো বহিরাগত শক্তি ঢুকে দলের ক্ষতি করতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে আর অন্যদিকে আমরা দেখলাম সাধারণ সম্পাদক নেতাকর্মীদের ভবিষ্যদ্বাণী দিচ্ছেন দল ক্ষমতায় না থাকলে কেউ টিকে থাকতে পারবে না, সবাইকে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। তাই সাবধান থাকতে হবে। বুঝতে পারিনি কথাটা। তিনি আসলেই কী বোঝাতে চাইছেন? তার ১/১১-এর ভূমিকা অবশ্য বিতর্কিত যদিও। জানি না তিনি কি তাহলে আরেকটা ১/১১-এর কল্পনা করতে পারছেন? দলের নেতাকর্মীদের কী মেসেজ দিতে চাইছেন তিনি? শেখ হাসিনা চলছেন একদিকে আর তার দলের অন্য নেতারা চলছেন আরেকদিকে। আওয়ামী লীগের অন্যান্য পদের লোকজনের ভূমিকা খুব একটা চোখে পড়ে বলে মনে পড়ছে না। দলের যে কোনো সিদ্ধান্তই এখনো পর্যন্ত একা শেখ হাসিনার উপরেই নির্ভর করে। অবশ্যই তিনি সভাপতি হিসেবে সিদ্ধান্ত নেবেন কিন্তু সিদ্ধান্তের পুরোটাই কি তার ওপর নির্ভর করার কথা? বাকিদের ভূমিকা কী তাহলে?

একই চিত্র শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায়। তিনি একা একদিকে আর বাকি সব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে প্রতিটা লোক তাকিয়ে থাকেন এক প্রধানমন্ত্রীর দিকে। সবটাই চলছে একজনকে নির্ভর করে। মাশরাফি দলে থাকবে কী থাকবে না থেকে শুরু করে, হাওর এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণে এবং মানব বিপর্যয় ঠেকাতে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে সবই ঠিক করতে হচ্ছে শেখ হাসিনাকে। অন্যদিকে কোন দেশের সঙ্গে কী দেনদরবার হবে, কী চুক্তি হবে তার সবই নির্ভর করছে শেখ হাসিনার একার বার্গেইনিং পাওয়ারের ওপর।

ব্যক্তি একজন সিদ্ধান্ত অনেক। প্রধানমন্ত্রী একজন মন্ত্রণালয় অনেক। সভাপতি একজন কিন্তু পরিষদের সদস্য অনেক। সমস্যা হাজার হাজার কিন্তু সিদ্ধান্তের জন্য নির্ভরশীল একজনের ওপর। এই যখন অবস্থা তখন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের কি খুব আশাবাদী হওয়ার কিছু আছে? এক হাসিনানির্ভর জাতি হয়ে বসে থাকলে আমাদের ভবিষ্যত কোথায় গিয়ে ঠেকবে? ১৬ কোটি জনগণ এখন তার ব্যক্তিগত থেকে শুরু করে রাষ্ট্রিক সব সমস্যার সমাধানের জন্য নির্ভর করছে একজনের ওপর। আবার সমালোচনার ভারও এই একজনকেই বইতে হচ্ছে। আমরাও ধরেই নিয়েছি যে সরকারের বাকি সব অথর্ব, ওদের দিয়ে আর আশা-ভরসা নাই। আমাদের একমাত্র আশার আলো একজনেই আটকে আছে। এই একজনকে চ্যালেঞ্জ করার মতোও কেউ নেই। সরকারের সমালোচনাকারীরাও ওই একজনের কাছেই আশা করেই সমালোচনা করেন। তারাও চান তাদের দাবি-দাওয়াগুলো শেখ হাসিনা পর্যন্ত পৌঁছাক। এটা অবশ্যই একজন শেখ হাসিনার অর্জন কিন্তু দল এবং দেশ দুইটারই দায়িত্ব যখন একক হয় তখন দশমাথার রাবণের পক্ষেও কুলানো সম্ভব নয়। সিদ্ধান্তের এদিক সেদিক আসতে বাধ্য। অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যায় যে, একজন শেখ হাসিনার পরামর্শকরাও আছেন তার পরামর্শের জন্য অপেক্ষায়। একব্যক্তিনির্ভর কোনো সিস্টেমই ভালো নয়। শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তকেও চ্যালেঞ্জ করার মতো লোক দলে বা মন্ত্রিপরিষদে নেই। গা বাঁচিয়ে সবাই কেবল রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করে যাবেন আর দেশের প্রতি জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালন করবেন না- এই হাওয়ায় গা ভাসানো সংস্কৃতি আমাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত। আমরা চাই রাজনীতিবিদরা কথা বলবেন অত্যন্ত ভেবেচিন্তে, জনগণের ইস্যুতে তারা থাকবেন সোচ্চার। তাদের দিকনির্দেশনায় থাকবে নেতৃত্বের বলিষ্ঠ ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রকাশ। কর্মীদের সামনে নেতারা থাকবেন আদর্শ। নেতার একটা কথাই হবে তাদের জন্য আদেশ। এক শেখ হাসিনা যেমন করে জনতার শেখ হাসিনা হয়ে উঠেছেন আমরা চাই অন্যরাও হয়ে উঠুন জনতার আদর্শ, কাছের কেউ যার ওপর তারা নির্ভর করতে পারবে, মনে করবে তিনি জানলেই আমার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। শেখ হাসিনাও তখন চিন্তা করতে পারবেন বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়ে, গ্লোবাল পলিটিকসে কীভাবে বাংলাদেশের জায়গা আরো দৃঢ় করা যায় তা নিয়ে। সামনের দিনে বাংলাদেশ হবে বিশ্বনেতাদের নেতা এমন স্বপ্নই আমরা দেখতে চাই।