সুঁইয়ের ফোঁড়ে স্বপ্ন জয়

এসেছিলেন প্রায় শূন্য হাতেই। অসচ্ছল স্বামীর সংসারে একটি সেলাই মেশিন নিয়ে পাড়ি জমান ঢাকায়। স্বপ্ন বুনেন সুঁইয়ের ফোঁড়ে। তার স্বপ্ন জয়ের সারথি এখন শতজন। নাটোরের গুরুদাসপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম মহারাজপুর থেকে এসে রাজধানী জয় করেছেন মাসুদা সরকার বন্যা। দর্জি থেকে এখন গার্মেন্টের মালিক তিনি। সফল এ নারী উদ্যোক্তার জীবনকথা যেন রূপকথার গল্প। ইচ্ছা, একাগ্রতা, মনোবল, আন্তরিকতা, পরিশ্রম আর সততায় ভর করে যে সাফল্য পাওয়া যায়, তারই জ্বলন্ত উদাহরণ বন্যা।

২০১২ সালের কথা। ঢাকায় ভাড়া বাড়িতে নিজের কক্ষে শুরু করেন কাপড় সেলাইয়ের কাজ। তৈরি করেন থ্রিপিস, স্কার্ট, ট্রপস, টি-শার্ট, শার্ট-প্যান্ট, বোরকাসহ নারী-পুরুষের সব ধরনের পোশাক। বাচ্চাদের পোশাকও তৈরি করতেন নিজের করা ডিজাইনে। সময় গড়ায়, পরিচিতি এবং আয়ও বাড়তে থাকে বন্যার। কিন্তু স্বপ্ন তো আকাশছোঁয়া। তাই এত স্বল্প পরিসরে তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। তবে যে স্বপ্ন দেখতে জানে, সে সফলতাও ছিনিয়ে আনতেও জানে। তাই সব প্রতিবন্ধকতাই পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে থাকেন বন্যা। নিজের পরিচিতি আর সততার মধ্য দিয়ে ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর চিন্তা করেন তিনি। প্রশিক্ষণ নেন সমাজকল্যাণ অধিদফতরে। প্রশিক্ষণে গোল্ডেন (এ+) প্লাস পেয়ে পাস করে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন বন্যা। আরও তিনটি মেশিন এবং একটি আয়রন কিনে দুই নারী ও এক পুরুষকে নিয়োগ দেন তিনি।
এতে ফ্ল্যাটের আলাদা কক্ষে মোট চারটি মেশিনে পুরো উদ্যমে পোশাক তৈরির কাজ শুরু হয়। বন্যা নিজেই রাজধানীর ইসলামপুর, সদরঘাটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে কাপড় কিনে আনেন। সেই কাপড় থেকেই নিজের ডিজাইনে পোশাক তৈরি করতে থাকেন। পরে নিজেই তৈরি পোশাকগুলো নিয়ে বিভিন্ন শোরুম ও মার্কেটের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরই মধ্যে অন্য একটি গার্মেন্টে কিছুদিন কাজ করে অভিজ্ঞতাও অর্জন করেন বন্যা। এতে সব মিলিয়ে মাসে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা আয় হতে থাকে তার। বদলে যেতে থাকে বন্যার জীবনের গল্প।
পরের বছর জমানো টাকা নিয়ে রাজধানীর মিরপুর ২ নম্বরে পুরনো একটি গার্মেন্টের ফ্লোর ভাড়া করে ২৫ কর্মী নিয়োগ দিয়ে কাজ শুরু করেন বন্যা। সাব-কন্ট্রাকের মাধ্যমে শুরু হয় এক্সপোর্টের পোশাক তৈরির কাজ। এরপর বাড়তে থাকে জনবল ও কাজের পরিধি। নাম দেন ‘বন্যা ফ্যাশন হাউজ’। বন্যার কারখানায় এখন কাজ করছেন প্রায় ৭০ কর্মী। এর মধ্যে ৪৬ জনই নারী কর্মী। কর্মীদের এখন বেতন মাসে প্রায় ৫ লাখ টাকা। তীব্র প্রতিযোগিতা আর চ্যালেঞ্জ নিয়ে বন্যা এখন আর দশজন সফল ব্যবসায়ীর মতোই নজির স্থাপন করেছেন।
নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা প্রসঙ্গে বন্যা বলেন, শুধু নিজের জন্যই নয়, আর দশজন অসহায় মানুষের জন্য কিছু করার বাসনা থেকেই এ উদ্যোগ নিয়েছি। এখানে শিক্ষাগত সার্টিফিকেটের চেয়ে অভিজ্ঞতা এবং কাজের প্রতি নিষ্ঠাই জরুরি বিষয়। নারী শ্রমিকদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পোশাক কারখানায় পুরুষের চেয়ে নারীরাই বেশি মনোযোগী। নারীদের কাজের গতিও বেশি।
বন্যা ফ্যাশন হাউজের নারী কর্মী সালমা, রতœা, তামান্নাসহ অনেকেই বলেন, নারী মালিকের অধীনে কাজ করায় সবসময় নিজেদের নিরাপদবোধ হয়। এছাড়া অন্যান্য গার্মেন্টের মতো এখানেও সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অফিস করি। এর চেয়ে বেশি সময় থাকলে তা ওভারটাইম হিসেবে বেতনের সঙ্গে অতিরিক্ত টাকা যোগ হয়। শ্রমিক সন্তুষ্টি থাকায় অল্প সময়ের মধ্যে এ গার্মেন্ট তার পরিসর বৃদ্ধি করে সফলতা অব্যাহত রেখেছে।
মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করা মাসুদা সরকার বন্যা বলেন, মনস্তাত্ত্বিকভাবেই নারীদের সবসময় পিছিয়ে রাখা হয় পারবে না বলে। কিন্তু ইচ্ছাশক্তি, একাগ্রতা, শ্রম, নিষ্ঠা ও সততা থাকলে নারীরাও সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। তবে এক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তাদের আরও উৎসাহিত করতে সরকারি সহায়তা জরুরি। বন্যার স্বামী সজীব আহমেদ বলেন, ও (বন্যা) যখন ব্যবসা করার কথা বলেছে, আমিও সে প্রস্তাবে রাজি হয়েছি। সুযোগ পেলে আমিও কারখানায় বসি। সংসার তো দুইজনেরই। একে অপরের হাত ধরে প্রতিটি পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে চাই।