বীর বাঙালির ঐতিহ্য

অন্যের বিপদে মুখ ফিরিয়ে থাকব, হাততালি দেব; নাকি সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজের বিপদের সঙ্গী বাড়াব? অসুখ হলে ঝাড়ফুঁক দেব; নাকি আধুনিক চিকিৎসা নেব? বাল্য বিবাহ দিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েদের জীবন বিনষ্ট করব; নাকি লেখাপড়া শিখিয়ে আত্মনির্ভরশীল করে সচেতন সংসারী হওয়ার সুযোগ করে দেব? ফাস্টফুড খেয়ে রোগাক্রান্ত হব; নাকি চিড়া-মুড়ি, মুড়কি-মোয়া খেয়ে সুস্থ থাকব?
মো. রহমত উল্লাহ্
ইদানীং মনে হচ্ছে পহেলা বৈশাখ মানেই পান্তা-ইলিশ। পান্তা-ইলিশ না হলে যেন পহেলা বৈশাখ উদযাপন হবে না। তাই গরম ভাতে পানি দাও। চড়া দামে মরা ইলিশ কিনো। ফ্রাইপেনে ভাজি (বারবিকিউ?) কর। পোড়া মরিচ সঙ্গে দাও। নিয়ে যাও বটমূলে। খাও টিভি ক্যামেরা এলে। তা না হলে তুমি কেমন বাঙালি? কিছুকাল আগেও ছিল না এমন হুজুগ।
এই পান্তাভাত আর মরিচপোড়া খাওয়া কি বাঙালির ঐতিহ্য? এসব কি বাঙালিরা শখ করে খেত? বিষয়টি এমন ছিল কি, পর্যাপ্ত গরম ভাত/পোলাও আর মাছ-মাংস ঘরে থাকার পরেও, তারা তা না খেয়ে, শখ করে পান্তাভাত আর মরিচপোড়া (ইলিশ নয়) খেয়েছেন প্রতিদিন? এমন ছিল কি, একাধিক বাহারি জামা-কাপড় থাকা সত্ত্বেও, তারা সেসব না পরে, শখ করে গামছা আর ডুমা পরেছেন সারাজীবন? নিশ্চয়ই নয়। তাহলে এসব আমাদের ঐতিহ্য হলো কেমন করে? আমাদের আদি নারী-পুরুষেরা অভাবে ছিল। চরম অনটনে ছিল। খেয়ে না খেয়ে ছিল। ছাই দিয়ে দাঁত মাজতো আর গামছা-ডুমা সাফ করত। অসুখ হলে ঝাড়-ফোক নিত। স্ট্রোক হলে, হার্ট অ্যাটাক হলে, অভিশপ্ত ভাবত।
শিশুকন্যা হলে, অটিস্টিক হলে, মাকে দায়ী করত। কারও মানসিক সমস্যা হলে জিনের কবিরাজ ডাকা হতো। পাতলা পায়খানা হলে পানীয় খেত না, খেতে দিত না। হেঁটে ২০-৩০ মাইল পাড়ি দিত। পান্তাভাত আর মরিচপোড়া খেয়ে মাঠে কাজ করতে যেত। খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাত।
তখন তারা পরাধীন ছিল। দাস-দাসী ছিল। মাথা নিচু করেছিল। হাতজোড় করেছিল। শূলে চড়েছিল। পাতাকে খাতা করে, কঞ্চিকে কলম করে, গোলানো ছাইকে কালি করে, আদর্শলিপি চর্চা করেছিল। এই সবই কি আমাদের ঐতিহ্য? আমরা কি সেই সবই করব এখনো? আমরা কি ছাই দিয়ে দাঁত মাজব? গামছা-ডুমা পোশাক পরব? বটমূলে গিয়ে শূলে চড়ব? যদি না হয়, তো পান্তাভাত নাটক করে কেন ব্যঙ্গ করব আমাদের আদি নারী-পুরুষ তথা আসল বাঙালিদের?
এসব তো ছিল আমাদের অক্ষমতা। ডিজিটাল যুগে এসব করে কি আমরা আমাদের অতীতের ব্যর্থতা ও অক্ষমতাকেই বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরছি না বারবার? কারা করছে এসব? যারা সারাবছর মাছ, মাংস, পোলাও খায়, চাইনিস খায়, থাই খায়, ইন্ডিয়ান পরে, অধিকাংশ তারাই শখ করে বছরে একদিন দেখায় এসব নাটক। গ্রামের সাধারণ মানুষ অতীতেও শখ করে পান্তাভাত আর মরিচপোড়া খাইনি এখনো শখ করে পান্তাভাত আর মরিচপোড়া খায় না। সেদিন আর বেশি দূরে নয় যে অনটনের কারণে বাধ্য হয়ে আমাদের কাউকেউ আর পান্তাভাত খেতে হবে না। যারা শখ করে খাবেন, তারা যখন যেভাবে খুশি খাকগে। আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
তাই বলে কি আমাদের কোনো ঐতিহ্য ছিল না, ঐতিহ্য নেই? অবশ্যই ছিল, অবশ্যই আছে। আমাদের ঐতিহ্য হচ্ছে_ অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করা। মাতৃভাষার জন্য জীবন দেয়া। স্বাধীনতার জন্য আমরণ যুদ্ধ করা। বর্গি তাড়ানো, ইংরেজ তাড়ানো, জমিদার হটানো, নীলকর তাড়ানো, পাকি হটানো। একতাবদ্ধ থাকা। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করা। অন্যের বিপদে এগিয়ে আসা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা। বাঁশের বাঁশি বাজানো। জারি-সারি-ভাটিয়ালি গাওয়া। অতিথি আপ্যায়ন করা। চিড়া, মুড়ি-মুড়কি, মোয়া খাওয়া। পিঠা-পুলি-পায়েশ খাওয়া। শুভ্র-শালীন পোশাক পরা। সত্য কথা বলা। সৎ পথে চলা। ওয়াদা রক্ষা করা। আমানত রক্ষা করা। কাজে ফাঁকি না দেয়া। খাদ্যে ভেজাল না দেয়া। ইত্যাদি যা কিছু তারা মনের আনন্দে, বিবেকের তাগিদে করেছেন তাই আমাদের ঐতিহ্য।
এখন আমাদের ভেবে দেখা উচিত, আমাদের আদি নারী-পুরুষদের কোন কর্মটিকে আমরা ঐতিহ্য হিসেবে লালন করব। ভেবে দেখতে হবে, পাতাকে খাতা, কঞ্চিকে কলম, গোলানো ছাইকে কালি করে আগডুম বাগডুম চর্চা করব; নাকি অত্যাধুনিক কম্পিউটার তৈরি করে, তাতে আমাদের আদি নারী-পুরুষদের প্রিয় আদর্শলিপি চর্চা করে আদর্শ মানুষ হব?
আমরা কি গামছা-ডুমার ডিজাইন করে অশালীন পোশাক পরব; নাকি কাজের উপযোগী ডিজাইন করে, লজ্জা নিবারণের উপযুক্ত করে শুভ্র-শালীন পোশাক পরব? বিরক্তিকর বিদেশি বাদ্যযন্ত্র সমেত অবাংলা কনসার্ট করব; নাকি মরমি সুরে আমাদের জীবনের গান, বিজয়ের গান, প্রতিবাদী গান গাইব? আমরা কি মেহমান এলে মন খারাপ করে তাড়িয়ে দেয়ার কৌশল করে হৃদ্যতা ধ্বংস করব; নাকি মনের আনন্দে আদর আপ্যায়ন করে হৃদ্যতা বাড়াব?
অন্যের বিপদে মুখ ফিরিয়ে থাকব, হাততালি দেব; নাকি সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজের বিপদের সঙ্গী বাড়াব? অসুখ হলে ঝাড়ফুঁক দেব; নাকি আধুনিক চিকিৎসা নেব? বাল্য বিবাহ দিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েদের জীবন বিনষ্ট করব; নাকি লেখাপড়া শিখিয়ে আত্মনির্ভরশীল করে সচেতন সংসারী হওয়ার সুযোগ করে দেব? ফাস্টফুড খেয়ে রোগাক্রান্ত হব; নাকি চিড়া-মুড়ি, মুড়কি-মোয়া খেয়ে সুস্থ থাকব?
আমাদের আদি নারী-পুরুষেরা নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অথবা অজ্ঞতার কারণে, অনটনের কারণে, যা কিছু করতে বাধ্য হয়েছিলেন বা করেছিলেন, সেসব আমাদের ঐতিহ্য নয়। সেসব আমাদের গ্লানি। সেসব আমরা ঘটা করে পালন করব কেন? বরং আমাদের আদি নারী-পুরুষেরা মনের আনন্দে, বিবেকের তাড়নায়, আমাদের কল্যাণকল্পে সপ্রণোদিত হয়ে স্বেচ্ছায় যা কিছু করেছেন, করতে চেয়েছেন, এসবই আমাদের ঐতিহ্য।
এসবই সযত্নে লালন করে আরও সমৃদ্ধ হতে হবে আমাদের। বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে তুলে ধরতে হবে এই বীর বাঙালির আসল ঐতিহ্য। সমস্বরে উচ্চারণ করতে হবে, আমাদের বিজয়ের ধ্বনি ‘জয়বাংলা’।

মো. রহমত উল্লাহ্: শিক্ষাবিদ ও অধ্যক্ষ কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ