সকালের ব্রাশ-পেস্ট থেকে শুরু করে রাতের মশারি। রাজধানীতে কেউ যদি এমন একটি বাজার খোঁজেন, তাহলে সবার আগে যে নামটি সবার মুখের উঠে আসবেÑ তা হলো কারওয়ান বাজার। এটি মূলত পাইকারি বাজার। তবে খুচরা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর সমারোহে ভরপুর। যানজট এড়াতে বাজারটি সরানোর উদ্যোগ নিয়েছে সিটি করপোরেশন। প্রায় এক লাখ লোকের কর্মসংস্থানে ভরপুর কারওয়ান বাজার তিন ভাগে ভাগ হচ্ছে। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হওয়া কারওয়ান বাজারের সার্বিক চিত্র নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন রুমানা রাখি ও গোলাম রাব্বানী
গভীর রাত। রাজধানীবাসী ঘুমে বিভোর। ঠিক তখনই সরগরম কারওয়ান বাজার এলাকা। পুরো এলাকায় অসংখ্য মানুষের হাঁকডাক। কোথাও সবজি ভিড়ছে, কোথাও বস্তায় বস্তায় চাল এনে রাখা হচ্ছে। আর চারপাশে ভিড় করছেন রাজধানীসহ আশপাশের পাইকাররা। ভোরে সূর্য ওঠার আগেই এসব পণ্য নিয়ে পাইকাররা ছুটছেন তার নিজ নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। আর এর মাধ্যমেই সারা রাত ওই এলাকায় চলে কোটি টাকার লেনদেন। গত বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে সকাল পর্যন্ত কারওয়ান বাজারের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে এসব চিত্র।
কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রাত ১২টার পর থেকেই বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাক এসে ভিড় করতে থাকে কারওয়ান বাজার এলাকায়। আর এসব পণ্য ট্রাক থেকে নামানোর জন্য প্রস্তুত কয়েক হাজার শ্রমিকসহ ভ্যান। রাত যত বাড়তে থাকে, ঢাকার আশপাশের পাইকারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এসে ভিড় করতে থাকেন কারওয়ান বাজারে। ভ্যান বা ছোট লরি নিয়ে ব্যবসায়ীরা সকালের সূর্য ওঠার আগেই এসব পণ্য নিয়ে ছোটেন তাদের নিজ নিজ এলাকায়। কারওয়ান বাজারের রাতের ওই চিত্র দেখলে মনেই হয় না গভীর কোনো রাত। মনে হয় কর্মব্যস্ত কোনো একটি দিন। তবে শুধু বৃহস্পতিবারের রাত নয়, প্রাত্যহিক কারওয়ান বাজারের চিত্র এটি।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমল থেকে কারওয়ান বাজার আছে। কারওয়ান সিং নামে এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী প্রথমে একটি মার্কেট খোলেন। পরে তার নামেই কারওয়ান বাজার পরিচিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮০ সালে ওই বাজারে ক্ষুদ্র কাঁচাবাজারে আড়ত নামের একটি মার্কেট সিটি করপোরেশনের আওতায় নেওয়া হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অন্তর্গত কারওয়ান বাজারের মোট আয়তন ৫০ একরেরও বেশি। এখানে অনেক আলাদা মার্কেট রয়েছে। এর মধ্যে সিটি করপোরেশনের আওতাধীন কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেট, সিটি করপোরেশন মার্কেট-১, সিটি করপোরেশন মার্কেট-২ বা সুপারমার্কেট ও কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র কাঁচাবাজার আড়তÑ এ চারটি মার্কেট রয়েছে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের আওতায় বেশকিছু টোল মার্কেট রয়েছে। আরও আছে সিটি করপোরেশনের আওতামুক্ত কিছু মার্কেট।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তিনটি পাকা মার্কেট ও কাঁচাবাজারের আড়তসহ গোটা কারওয়ান বাজারে অন্তত দুই হাজার দোকান রয়েছে। আর শুধু কাঁচাবাজারের কথা বলতে গেলে এর সংখ্যা হবে কমপক্ষে ৩০০। এর মধ্যে সিটি করপোরেশনের আওতায় পাকা আড়ত ভবনের নিচতলায় ৬৩টি, উপরে ১১৩টি এবং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দোকান আছে আরও প্রায় ১১৮টি। এ ছাড়া এই বাজার ঘিরে আরও ভাসমান দোকানপাট রয়েছেÑ যেখানে চা-সিগারেট বা হালকা নাশতার জন্য খাদ্য-খাবার বিক্রি হয়। এসব মার্কেটের সঙ্গে যুক্ত প্রায় লাখ মানুষ।
ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিদিন কয়েক কোটি লেনদেন হয় এই মার্কেটে। সব থেকে বেশি বেচাবিক্রি হয় সবজি। ঢাকার চারপাশের ব্যবসায়ীরা কারওয়ান বাজার থেকে সবজি কেনেন। পাইকারি বাজার থেকে কমপক্ষে এক পাল্লা বা পাঁচ কেজি কিনতে হবে। এর সঙ্গে ক্রেতাকে দিতে হবে কয়েলি বা বাজারের চাঁদা। এটি আড়াই শতাংশ হারে। পাইকারি বাজারের পাশাপাশি এখানে খুচরা বাজারও রয়েছে। তবে ৩৪ বছর আগে গড়ে ওঠা কারওয়ান বাজার এখন রাজধানীবাসীর কাছে বিষফোঁড়া।
কারওয়ান বাজার মানেই এখন যানজট, ময়লা, আবর্জনা, কাদাযুক্ত এলাকা। সর্বোপরি এখানে বিরাজ করছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে অসহনীয় যানজট। সামান্য বৃষ্টিপাতেই বাজারের অবস্থা আরও অসহনীয় হয়ে উঠছে। রাত ১০টার পর শত শত ট্রাক কাঁচামাল নিয়ে কারওয়ান বাজারে ভিড় করছে। সারা রাত ধরে চলে মাল ওঠানো-নামানো। কারওয়ান বাজারের এই ব্যস্ততার প্রভাব গিয়ে পড়ে মূল সড়কে, এমনকি রেললাইন ও এর আশপাশে।
রাজধানীর যানজট নিরসনে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কারওয়ান বাজারটি ঢাকার চারটি স্থানে সরিয়ে নেওয়ার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ চারটি বাজার হলো মহাখালী, আমিনবাজার, যাত্রাবাড়ী ও লালবাগ। তবে লালবাগ প্রকল্পটি পরে স্থগিত করা হয়েছে। তিনটি কাঁচাবাজার ৩৩১ কোটি ৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। ২০০৬ সালের ২৬ এপ্রিলে একনেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বিদ্যমান কারওয়ান বাজারের দোকান মালিকদের ওই চার বাজারে পুনর্বাসন করা হবে।