ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রি বন্ধ এবং ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে সারা দেশের ওষুধের দোকানগুলো আধুনিক করার উদ্যোগ নিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই উদ্যোগ সফল হলে মানুষের মানসম্পন্ন ওষুধ পাওয়ার এবং ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহারের সুযোগ বাড়বে।
অধিদপ্তরের এই উদ্যোগ ‘দ্য বাংলাদেশ ফার্মেসি মডেল ইনিশিয়েটিভ’ নামের দিশারি প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর আওতায় গত চার মাসে অধিদপ্তর রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরের ৭৪টি ওষুধের দোকানকে ‘মডেল ফার্মেসি’ এবং ৩২টি দোকানকে ‘মডেল মেডিসিন শপ’ ঘোষণা দিয়েছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফার্মেসি এবং ওষুধের দোকান স্থাপন ও পরিচালনার জন্য আমরা মান নির্ধারণ করেছি। এ জন্য দোকানমালিক, দোকানের কর্মচারী ও মাঠপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে গুড ফার্মেসি প্র্যাকটিস বা ভালো ফার্মেসি চর্চার বিস্তার ঘটানো।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গত বছরের ২২ ডিসেম্বর রাজধানীর কলাবাগানের লাজ ফার্মা ও পান্থপথের বায়োমেড ফার্মেসিকে মডেল ফার্মেসি ঘোষণা দিয়ে এই উদ্যোগের উদ্বোধন করেন।
লাজ ফার্মা ৪৫ বছরের পুরোনো ওষুধের দোকান। সম্প্রতি ওই দোকানে গিয়ে দেখা যায়, দোকানের সামনে ‘মডেল ফার্মেসি’ সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের লোগো।
লাজ ফার্মার ব্যবস্থাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের শর্ত মানার জন্য আমাদের বাড়তি বিনিয়োগ করতে হয়নি। অভ্যন্তরীণ সাজগোজে কিছু পরিবর্তন এনেছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শীতেষ চন্দ্র বাছার বলেন, এটি অত্যন্ত ইতিবাচক উদ্যোগ। এর মাধ্যমে দেশের ডিগ্রিধারী ফার্মাসিস্টদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। আর ফার্মাসিস্টদের মাধ্যমে রোগীর হাতে ওষুধ গেলে ওষুধ ব্যবহারের মান বাড়বে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১ লাখ ২৫ হাজার নিবন্ধিত ওষুধের দোকান আছে। এ ছাড়া প্রায় ১৮ হাজার দোকানের কোনো ধরনের সরকারি অনুমোদন নেই। অধিদপ্তরের সিদ্ধান্ত, ওই ১৮ হাজার ওষুধের দোকান তারা বন্ধ করে দেবে। এ ছাড়া শর্ত পূরণ না করলে কোনো দোকানের নিবন্ধন নবায়ন করবে না। এ বিষয়ে অধিদপ্তর ৪ এপ্রিল একটি অফিস আদেশ জারি করেছে।
নির্দেশিকা অনুযায়ী মডেল ফার্মেসিতে (লেভেল-১) কমপক্ষে একজন স্নাতক ডিগ্রিধারী ফার্মাসিস্ট থাকবেন, তাঁকে সাহায্য করবেন বাংলাদেশ ফার্মাসিস্ট কাউন্সিল থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া বিভিন্ন পর্যায়ের ফার্মাসিস্ট। আর মডেল মেডিসিন শপে (লেভেল-২) থাকবেন কমপক্ষে ডিপ্লোমাধারী ফার্মাসিস্ট। বাংলাদেশ ফার্মাসিস্ট কাউন্সিল থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া বিভিন্ন পর্যায়ের ফার্মাসিস্ট তাঁকে সহায়তা করবেন। প্রশিক্ষণ নেই এমন কেউ ফার্মেসি বা ওষুধের দোকানে ওষুধ কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারবে না। এই প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলে নতুন ফার্মাসিস্টদের প্রশিক্ষণ চলছে।
জাতীয় ওষুধনীতিতে উল্লেখ করা ৩৯টি ওষুধ ছাড়া কোনো ওষুধ ব্যবস্থাপত্রবিহীন বিক্রি করা যাবে না। দোকানের ভেতরের তাপমাত্রা ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে এবং বিশেষ ওষুধ বা টিকা রাখার জন্য দোকানে ফ্রিজ থাকতে হবে। ওষুধের দোকানে খাদ্যসামগ্রী রাখা যাবে না। সঠিকভাবে ওষুধ ক্রয়-বিক্রয়ের হিসাব রাখতে হবে। নিবন্ধনহীন ওষুধ, সরকারি ওষুধ ও চিকিৎসককে দেওয়া কোম্পানির নমুনা ওষুধ বিক্রি হবে না। এসব শর্ত পূরণ হলেই তারা সরকারের সনদ পাবে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক রুহুল আমিন বলেন, ডিগ্রিধারী ফার্মাসিস্ট রাখার উদ্দেশ্য হচ্ছে রোগীকে দেওয়ার আগে ওষুধের মেয়াদ দেখা, ওষুধ দেওয়ার সময় সেবনবিধি বুঝিয়ে বলা। বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে রোগীকে তথ্য ও পরামর্শ দেবেন। এতে ওষুধের সঠিক ব্যবহারের নিশ্চয়তা বাড়বে এবং অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার কমবে।
স্বীকৃতি পাওয়া বায়োমেড ফার্মেসির ওপরের তলায় বিশিষ্ট চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম ইউ কবীর চৌধুরীর চেম্বার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ওষুধ লিখে দিই, দোকানদার অনেক সময় না বুঝে অন্য ওষুধ দিয়ে দেয়। দোকানে ফার্মাসিস্ট থাকলে সেই ভুল কম হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তে ওষুধ সেবনের মান বাড়বে। ওষুধ ও চিকিৎসকের ওপর রোগীরও আস্থা বাড়বে।’