প্রতিবন্ধীদের জন্য কিরণের লড়াই শুধু কেতাবি নয়

মিজানুর রহমান কিরণ। ব্যতিক্রমী এক লড়াকু। তার এ লড়াই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে। প্রথাগত সামাজিক বিশ্বাস আর গোঁড়ামির বিরুদ্ধে। এ লড়াই সমাজের প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার আদায়ে। দীর্ঘ ৯ বছর ধরে এ লড়াইয়ে রয়েছেন তিনি। শুধু তিনিই নন, এই লড়াইয়ে যুক্ত রয়েছেন অনেকেই। লড়াকুরা বলছেন- প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, তারাও সম্পদ। কিন্তু কিরণের লড়াইটা একেবারেই ভিন্ন। তিনি বিশ্বাস করেন- লড়াইয়ে জিততে হলে পরিবর্তনটা নিজের মধ্যেই আনতে হবে। খুব কাছ থেকেই তাদের বিষয়টা উপলব্ধি করতে হবে। নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলতে হবে। তবেই না কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে। তাইতো তিনি কাগজ-কলমে, বক্তৃতা-বিবৃতিতে, উপদেশ-পরামর্শে এ আন্দোলনকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। জড়িয়ে নিয়েছেন জীবনের সঙ্গে। জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন দৃষ্টিহীন এক নারীকে। তাকে সঙ্গে নিয়েই পথচলা তার। এগিয়ে যাওয়া কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। পরিবর্তনের মন্ত্র বলতে তিনি বোঝেন- আমি থেকে তুমি। বিশ্বব্যাপী প্রতিবন্ধীবান্ধব সমাজ গঠনের লক্ষ্য এই দম্পতির।
১৯৮৭ সালের ১৬ই জুলাই সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার আগুরিয়া গ্রামে জন্ম মিজানুর রহমান কিরণের। যমুনা পাড়ে চর এলাকার শিশুরা সাধারণত একজন তাঁত শ্রমিক হওয়ারই স্বপ্ন দেখে। কিরণও তাদেরই একজন। কিন্তু স্বপ্নটা ছিল ভিন্ন। সেই স্বপ্নই তাকে আজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। সমপ্রতি প্রভাবশালী সাময়িকী ফোর্বসে স্থান করে নিয়েছে এই তরুণ। এশিয়ার সেরা ৩০ জন সামাজিক উদ্যোক্তার ২ বাংলাদেশির তিনি একজন।
মিজানুর রহমান কিরণ ২০০৬ সালে উচ্চ শিক্ষার্থে ভর্তির সুযোগ পান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান সামাজিক ও কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে সব সময় নিজেকে জড়িত রাখেন। ২০০৮ সালে সাভারের সিআরপি’র প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক বৃটিশ বংশোদ্ভূত ভেলরি এ টেইলর শারীরিক প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করেন। ওই সেমিনারে ১৬ জন উপস্থিত ছিলেন। কিরণ তাদের মধ্যে একজন। এরপর ওই বছরের ৬ই জুলাই ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (পিডিএফ) নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলেন তিনি। এরপর সংগঠনটি দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও কার্যক্রম শুরু করে। এ সংগঠনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৫ হাজারের অধিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিবন্ধীর কল্যাণার্থে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ নিয়ে নানা অভিজ্ঞতা অর্জন ও শিক্ষা নেয়ার জন্য ২০১৩ সালে যোগদেন ব্র্যাক-এ। ২০১৫ সালে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটস এর আমন্ত্রণে এটলাসকোর ফেলো হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে যান। উদ্দেশ্য ছিল- প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ে তাদের প্রক্রিয়াটা আয়ত্ত করা। এ সময় তার সুজোগ হয় হোয়াইট হাউস, বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নামি প্রতিষ্ঠানে দেশের কথা তুলে ধরার।
মহাখালীর ব্রাক সেন্টারে কথা হয় এই তরুণ উদ্যোক্তার সঙ্গে। তিনি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নানা চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন। কথা বলেন, তাদের অধিকার নিয়ে। তাদের প্রতি সমাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও তা উত্তরণের নানা দিকও তুলে ধরেন। একজন দৃষ্টিহীন জীবনসঙ্গী নিয়ে তার পথচলার কথাও বলেন। সেই গল্পজুড়ে স্ত্রীর প্রশংসা।
পিডিএফের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মিজানুর রহমান কিরণ বলেন, প্রতিবন্ধী মানুষ বিশ্ববৈচিত্র্যের একটি ভিন্ন রূপমাত্র। তাদের আলাদা কিংবা অবহেলার চোখে দেখার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আমাদের পরিবারেরই সদস্য, আমাদের ভাই-বোন। তাই একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে সাধারণ মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত’ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মূল্যায়ন করেন এভাবেই। তিনি বলেন, শুধু আমাদের সমাজে নয়, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি মানুষের মধ্যেই প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে নানা ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও কুসংস্কার রয়েছে। প্রথাগত সামাজিক বিশ্বাস আর গোঁড়ামির মানসিকতা থেকেই এর সূচনা। এই নেতিবাচক ধারণাগুলো তাদের অধিকার আদায় এবং নিজের যোগ্যতা প্রমাণের পথে অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের মেধা ও মননশীলতার পরিচয় দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি তার দৃশ্যমান শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করলেও অনেক সময় সমাজ এবং তথাকথিত আইনের সীমাবদ্ধতা তার প্রতিভা বিকাশের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বলেন, পিডিএফের মধ্য দিয়ে আমরা এমন একটি প্ল্যাটফরম সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি, যেখানে তরুণ প্রজন্ম শিখবে, কীভাবে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সামর্থ্যের দৃশ্যমান সীমিত সীমাবদ্ধ তাকে বিবেচনায় রেখে তাদের সার্বিক সামর্থ্য মূল্যায়ন করতে হয়। আমাদের দেশে অধিকাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জীবনে চলার পথে মূল প্রেরণার উৎস তাদের পরিবার। এখন সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজের সব মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার। এর জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
খুব কম সংখ্যক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিই বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতে, নিজেকে যোগ্য ও দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার মানসিকতা তৈরি করতে পারে। কারণ, সমাজের তথাকথিত কিছু মানুষ প্রতিবন্ধী মানুষকে সব সময় বলতে থাকে, কি হবে তোকে দিয়ে! এমন হতাশাব্যঞ্জক কথা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মস্পৃহা নষ্ট করে দেয়।
কিরণ বলেন, অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি হয়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজ করতে গিয়ে তাকেও নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বলেন, আমরা পরিবর্তন করতে চাচ্ছি আমাদের প্রজন্মকে, যারা ভবিষ্যতে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে যাবে। একটি প্রজন্মের মন-মানসিকতার পরিবর্তন করতে পারলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আর বেশি অ্যাডভোকেসি করতে হবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এই তরুণ জানান, বর্তমানে পাবলিক ও বেসরকারিসহ মোট ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিডিএফের কমিটি কাজ করছে। প্রতিবন্ধী-অপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা এসব কমিটি পরিচালনা করছেন। নিজেরা চাঁদা দিয়ে প্রয়োজনীয় খরচ মেটাচ্ছেন এর সদস্যরা। এই টিম-স্পিরিট বড় পাওনা বলে মনে করেন তিনি। বলেন, পিডিএফসহ বিভিন্ন সংগঠনের সহায়তায় বিসিএস পরীক্ষায় প্রতিবন্ধীদের জন্য এক শতাংশ কোটা সম্ভব হয়েছে। তবে এ পরিবর্তনে নেতৃত্বে ছিলেন, স্বপন ভাই যিনি একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী অ্যাডভোকেট অর্থাৎ আমাদের প্রয়োজন তাদের পাশে থাকা, বাকিটা তারাই পারবে। তিনি আরো বলেন, শিক্ষার্থীরা যাতে প্রতিবন্ধীতা নিয়ে গবেষণা করতে পারেন, সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য কোটা বাড়ানো, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে ‘সামার চ্যালেঞ্জ’ নামে প্রতিযোগিতা আমাদের নিয়মিত আয়োজন।
মিজানুর রহমান কিরণ জানান, তিনি ২০১২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী সুরাইয়া আকতার বাবলীকে বিয়ে করেন। সেই বিয়েতেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছিল তার। মায়ের চোখে-মুখে শত প্রশ্ন। একটা অন্ধ মেয়ে, বাবার কোনো সম্পদ নেই, ভবিষ্যৎ নাতিপুতি অন্ধ হবার সম্ভাবনা, সংসারের কাজ কীভাবে করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সবার কথা শুনে শারমিনও প্রায় দ্বিমতের পথে। পুরো বাসায় পিনপতন নীরবতা। কিন্তু শেষমেশ সব বাধা তিনি ডিঙাতে পেরেছেন। স্ত্রীর প্রতিবন্ধীতা সংসারে কোনো সমস্যার সৃষ্টি করে কিনা, জানতে চাইলে মিজানুর বলেন, দৃষ্টিহীন এই মেয়েটিই তো আমার পথের আলো। বলেন, বাবলীর একটা অসাধারণ ক্ষমতা হল ওর প্রজ্ঞা। হলফ করে অনেক দূরের ভবিষ্যৎ বলতে পারে। আমি মুগ্ধ হয়ে সেটা উপভোগ করি। চোখ থাকলে হয়তো সামনের সবকিছু দেখা যায় যেটা সে পারে না, কিন্তু সে যা দেখে তা আমাদের এতগুলো চোখ একসঙ্গেও দেখে না।
প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজে আগ্রহী হওয়ার ব্যাপারে ফোর্বসে স্থান পাওয়া এই তরুণ সিআরপির ভ্যালরি এ টেইলরের কথা স্মরণ করেন। ভ্যালরি তাকে বলেছিলেন, ‘আমরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিচ্ছি। কিন্তু গণসচেতনতা তৈরি করতে পারছি না।’ এই কথায় উৎসাহিত হয়ে প্রথমে তিনি নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ শুরু করেন, পরে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়কেও সম্পৃক্ত করেন। তার প্রতিষ্ঠিত এ সংগঠনটি স্বপ্ন দেখছে, ‘লাইট হাউস’ নামের একটি প্রকল্পের। এতে এমন ব্যবস্থা থাকবে যাতে একটি নির্দিষ্ট নম্বর টিপলেই প্রতিবন্ধীরা চাহিদা অনুযায়ী সেবা পান। এমন একটি তথ্যভাণ্ডার থাকবে, তা থেকে কোন প্রতিবন্ধী কোন ধরনের চাকরি করতে পারবেন সেগুলোসহ তাদের নানা প্রয়োজনীয় জিনিস থাকবে। ২১ শতকের দক্ষতা প্রদান করাই হবে এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য।