তালিকায় নিচ থেকে উপরে উঠতে উঠতে দেখি একদম প্রথমে আমার নাম: ইহসান

‘আমাদের বাড়িটা ছিল ময়মনসিংহ শহরের একেবারে কেন্দ্রে। বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। ছোট থেকেই দেখতাম কেউ বাসায় আসলে বলত ‘এটা কি স্যারের বাসা? অন্যদের বাসায় গিয়ে তাদের নাম ধরে ডাকলেও আমাদের বাসায় এসে বলত স্যার অাছেন? এ বিষয়টাই মনে গেঁথে যায়। বুঝতে পারি এটা একটা আলাদা সম্মান। আর পেছনে যা রয়েছে তা হল শিক্ষা। তখন থেকেই সিদ্ধান্ত নেই উচ্চ শিক্ষিত আমাকে হতেই হবে।’

তিনি আমীমুল ইহ্সান খান। ২৭ তম বিসিএসে কাস্টমসে প্রথম। বাড়ি ময়মনসিংহ বিভাগের স্টেশন পাড়ায়। ৬ ভাইবোনের মধ্যে মধ্যে ইহসান তৃতীয়। ১৯৯৪ সালে ময়মনসিংহ গভঃ ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে স্টার মার্কস নিয়ে মাধ্যমিক। ১৯৯৬ সালে আনন্দমোহন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হলেও কখনই ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবার ইচ্ছা ছিলনা এই কর্মকর্তার। সাহিত্যের প্রতিই মনোযোগটা ছিল বেশি।

অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে  ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে নম্বরে সবসময়ই থাকতেন এগিয়ে। আর তাই যখন ইংরেজি সাহিত্যে পড়ার সুযোগ আসে তখন আর হাতছাড়া করেননা । ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যে।

প্রথম বর্ষ থেকেই ভাবতে থাকেন বিসিএস নিয়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাওলানা ভাসানী হলের ছাত্র ছিলেন। প্রতিদিনই ১৫ থেকে ১৬ টা সংবাদপত্র আসত হলে। তবে সারাদিন ভিড় থাকায় ধারে কাছেও ভিড়তে পারতেন না সেসব খবরের কাগজের । এজন্য এহসান মনে মনে এমন একটা সময় খুঁজে বের করেন খবরের কাগজ পড়ার। যখন পেপার রুমটা থাকত একবারেই ফাঁকা। দুপুরে খাবার পর সবাই যখন বিশ্রাম নিত। তখনই ইহ্সান নিয়ে বসতেন খবরের কাগজ। একের পর এক পড়ে ফেলতেন সবগুলো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন সব। আর এটাই পরবর্তীকালে তার বিসিএসের ভিত গড়তে সহায়তা করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রোটারঅ্যাক্ট সংগঠনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পাঠ্যপুস্তকের পড়াশোনা বাদে সাংগঠনিক সবকাজেই ছিলেন অতি উৎসাহী। বিশ্ববিদ্যালয় করসপনডেন্ট হিসেবে কাজ করতেন ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস ও নিউ নেশনে।ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক।

এর পাশাপাশি প্রথম বর্ষ  থেকেই নিতে থাকেন বিসিএস’র প্রস্তুতি। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হওয়ায় ইংরেজির ওপরে বিশেষ মনোযোগ দিতে হয়নি। পত্র-পত্রিকা পড়ার অভ্যাস থাকায় প্রস্তুতি নিতে গিয়ে দেখতে পান সিলেবাসের প্রায় অর্ধেকই পড়া হয়ে গেছে।

প্রথম অংশ নেন ২৬তম বিসিএসে। সেখানে মনোনীত হন শিক্ষা ক্যাডারের জন্য। নিয়োগ পান নেত্রকোণা সরকারি কলেজের ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে। তবে কর্মস্থলে যোগদানের পর বুঝতে পারেন এটা ঠিক তার আগ্রহের বিষয় না।

‘প্রতিদিন একই বিষয় পড়াতে হত। ১ মাস পরও একই বিষয় আবার ১ বছর পরও তাই। মনে হত আমি একটা গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। আর সেই গণ্ডী থেকে বের হতেই দিই ২৭ তম বিসিএস।’

২৭ তম বিসিএস’ই এই কর্মকর্তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তবে এ পথটা মোটেও মসৃণ ছিলনা তার। পরীক্ষা দিয়েই তিনি বুঝতে পারেন লিখিত পরীক্ষা যেমন দিয়েছেন তাতে নিশ্চয়ই ভাল করবেন। তবে ফল প্রকাশের দিনে এক নিমিষেই উড়ে যায় সব ভাললাগা।

‘খুব কষ্ট পাই যখন দেখি আমার রোলনম্বরটি নেই তালিকায়। মনটা ভেঙ্গে যায়। হতাশ লাগতে শুরু করে। বারবার ভাবতে থাকি এত ভাল পরীক্ষা দেয়ার পরও কেন হলনা।’

তবে খুব বেশিদিন এ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়না তাকে। তত্ত্বাবধায়ক  সরকার সেসময় ক্ষমতায় আসেন। ক্ষমতায় উপনীত হয়েই আগের ফলাফল বাতিল করে দেন। নতুন করে আবার ডাকা হয় মৌখিক পরীক্ষার জন্য।

ভাইভার পর অাসে ফলাফলের সেই কাঙ্খিত দিনটি। ‘যখন জানতে পারি ফল প্রকাশ হয়েছে তখন নিজের রোল নম্বরটি খুঁজতে থাকি। সব ক্যাডারে নিচের দিক থেকে খুঁজতে থাকি।’

নিজের রোল নম্বরটি এসময় কোথাও খুঁজে না পেয়ে খুব হতাশ হয়ে পড়েন।

‘এর মাঝে এক কাজিন ফোন করে জানায় সে  পুলিশে নির্বাচিত হয়েছে। তখন হতাশা আরও বেড়ে যায়। এভাবে খুঁজতে খুঁজতে কাস্টমস ক্যাডারের তালিকায় নিচ থেকে উপরে উঠতে উঠতে দেখি একদম প্রথমে আমার নাম।’

তখন কি যে ভাল লাগে তা বলে বোঝাতে পারবনা। পরীক্ষা ভাল দিয়েছিলাম তাই বলে যে এতটা ভাল দিয়েছিলাম যে একেবারে প্রথম হয়ে যাব সেটা বুঝিনি।’ এই অনুভূতিটা একেবারেই অন্যরকম বলে উল্লেখ করেন তিনি।

২৭ তম বিসিএসে কাস্টমসে ৬ জন কর্মকর্তা যোগ দেন সহকারি কমিশনার হিসেবে। তাদের মধ্যে ৫ জন সফল হন দ্বিতীয়বার মৌখিক পরীক্ষার পর। মা-বাবার আশীর্বাদ আর বিসিএসকে টার্গেট করে দেয়া শ্রমকেই সাফল্যের চাবিকাঠি বলে উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।

২৪ নভেম্বর ২০০৮ সালে যোগ দেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে। সেখান থেকে পরবর্তীসময়ে ৪ মাসের বুনিয়াদী প্রশিক্ষণের জন্য যান চট্টগ্রাম কাস্টমস একাডেমিতে। সবুজ গাছপালা বেষ্টিত। প্রকৃতির মাঝে মনোমুগ্ধকর এ ট্রেনিং সময়ের পুরোটাই অত্যন্ত আনন্দায়ক ছিল ইহ্সানের কাছে।

ট্রেনিং করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই শিখেছেন নতুন কিছু। হয়েছেন নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন। ট্রেনিং এর অংশ হিসেবে একদিন গভীর সমুদ্রে জাহাজে তল্লাশি চালাতে গিয়ে তাদের বহনকারি জাহাজ রামেজিং তাকে গভীর সমুদ্রে রেখেই চলে আসে। এরপর অবশ্য যোগাযোগ করে দ্র্রুতই উদ্ধার হতে সক্ষম হন।

প্রথম যোগ দেন সহকারি কমিশনার হিসেবে ঢাকা কাস্টম হাউজের অধীনে বিমানবন্দরে।

তবে কর্মজীবনে সাড়ে ৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় চালান আটক করেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে থাকা অবস্থায়। এ সময় বিভিন্ন কোম্পানির ৫৫ হাজার ২০০ কার্টন সিগারেট আটক করেন। যেখানে মোট ১ কোটি ১০ লাখ শলাকা সিগারেট ছিল। এই কার্টন আটক করতে গিয়ে তাকে ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে অনেক। বিভিন্ন মহল থেকে এসেছে চাপ। তথাপি তিনি দায়িত্ব থেকে পিছপা হননি।

কর্মক্ষেত্রে প্রিয় ব্যক্তিত্ত্ব কাস্টমস কমিশনার মাসুদ সাদিকের বলা, ‘সবার সঙ্গে অভিন্ন আচরণ করবে। কারও সঙ্গে ভিন্ন আচরণ করতে গেলেই পড়ে যাবে বিপদে।’ কথাগুলো মেনে চলার চেষ্টা করেন সবসময়।

কর্মক্ষেত্রে সাহসিকতা ও  সততার পুরস্কার স্বরুপ ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক শুল্ক দিবসে সার্টিফিকেট অব মেরিট পুরস্কার লাভ করেন।

বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত বৃত্তি নিয়ে ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব গ্রিনইউচ থেকে মাস্টার্স করেছেন ইন্টারন্যাশনাল বিজনেসে।। বর্তমানে কর্মরত আছেন বোনাপোল কাস্টম হাউজের যুগ্ম কমিশনার হিসেবে।

বিসিএস পরীক্ষার্থীদের উদেশ্যে এই কর্মকর্তা বলেন, ১ বা ২ বছরের প্রস্তুতি দিয়ে নয়। বিসিএস দেয়ার জন্য একটা মানসিক প্রস্তুতি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম থেকেই থাকা দরকার। এতে ধীরে ধীরে ভিতটা তৈরী হয়ে যাবে। আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতির চেয়ে অনানুষ্ঠানিক প্রস্তুতি এক্ষেত্রে অনেক বেশি কার্যকর।

পথ চলতে চোখ কান খোলা রাখাটাও বিসিএস প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ১ ধাপ এগিয়ে থাকার সহায়ক বলে উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।

তবে বিসিএস হোক বা না হোক সেটা বড় বিষয় নয়। এমনভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে যাতে বলা যায় আমি চেষ্টার কোন ত্রুটি করিনি। ‘আর বিশ্বাস থাকলে সাফল্য আসবেই।’