আরও দুটি জাত উদ্ভাবন ॥ ধান উৎপাদনে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সম্ভাবনা

ব্রি ৭৯ আমন মৌসুমের বন্যাসহিষ্ণু জাত যা ২১ দিন পর্যন্ত পানির নিচে টিকে থাকতে পারে
ব্রি ৮০ সুগন্ধিযুক্ত আমনের জাত, অনেকটা থাইল্যান্ডের জেসমিনের মতো; বিদেশে রফতানিযোগ্য
এমদাদুল হক তুহিন ॥ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) বিজ্ঞানীরা আরও দুটি নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন। সর্বশেষ উদ্ভাবিত ব্রি-৭৯ ও ব্রি-৮০ জাতের ধান দুটি এখন জাতীয় বীজ বোর্ডের অনুমোদনের অপেক্ষায়। এর মধ্যে ব্রি-৮০ সুগন্ধীযুক্ত আমনের জাত, যা অনেকটা থাইল্যান্ডের জেসমিনের মতো। ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে জেসমিন চালের প্রচুর চাহিদা থাকায় ওইসব বাজারে ব্রি-৮০ জাতের চাল রফতানির অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা। আর ব্রি-৭৯ আমন মৌসুমের বন্যা সহিষ্ণু জাত, যা ২১ দিন পর্যন্ত পানির নিচে টিকে থাকতে পারে। ফলে যেসব অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়, ওইসব অঞ্চলে ব্রি-৭৯ আবাদের মাধ্যমে ধান উৎপাদনে নতুন দিগন্তের সূচনা হতে পারে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ ছাড়কৃত ব্রি-৭৮ রোপা আমন মৌসুমে উপকূলীয় লবণাক্ততা ও জোয়ার-ভাটা সহিষ্ণু জাত, এর গড় ফলন প্রায় সাড়ে ৫ টন। হাইব্রিড জাতের মধ্যে ব্রি উদ্ভাবিত সর্বশেষ জাত ব্রি হাইব্রিড ৫। বোরো মৌসুমের এ জাতটি দেশীয়ভাবে উদ্ভাবিত হওয়ায় এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি। বৈরী পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতাও প্রবল। এ জাতের ধান উৎপাদনে হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ৭ থেকে ৮ টন। কৃষিবিদরা মনে করেন, উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন নিত্য নতুন ধানের জাত উদ্ভাবনের ফলে ব্রি’র বিজ্ঞানীরা ধান উৎপাদনে ঈশ্বর্ণীয় সাফল্য রেখে চলছেন। আর বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সর্বশেষ উদ্ভাবিত এ জাতগুলোর আবাদের ফলে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নতুন মাইলফলক স্পর্শ করতে পারে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে এসব জাতের চাল রফতানির মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা। জেসমিনের বাজার দখলের মাধ্যমে দেশ বয়ে আনতে পারে চালের বাজারে অন্য রকমের সুনাম। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. ভাগ্য রাণী বণিক জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের উদ্ভাবিত নতুন জাতগুলো পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

একইসঙ্গে জাতগুলো উচ্চগুণ সম্পূর্ণও। আমাদের বিজ্ঞানীরা ক্রমাগত খরা সহিষ্ণু, বন্যা সহিষ্ণু ও জিংক সমৃদ্ধ নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করছেন। এ ধারাবাহিকতায় ব্রি-৭৯ ও ব্রি-৮০ জাতের ধান উদ্ভাবিত হয়েছে, যা এখন জাতীয় বীজ বোর্ডের চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়।

ব্রি-৮০

ব্রি-৮০ আমন মৌসুমের জাত। সুগন্ধী এবং এর চাল চিকন। জীবনকাল ১২০ থেকে ১২৫ দিন। ফলে এ জাতের ধান আবাদের ফলে ওই জমিতে রবি শস্যের উৎপাদনও সম্ভব হবে। বিজ্ঞানীদের তথ্যমতে, থাইল্যান্ডের জেসমিনের পরিবর্তক হিসেবে এ জাত ব্যবহৃত হতে পারে। মূলত এ জাতের চাল দিয়ে জর্দা তৈরি হবে। বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা বলছেন, এটি দিয়ে বিদেশে ব্রান্ডিং করা সম্ভব। ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় যেখানে জেসমিন চালের বাজার রয়েছে সেখানে এ চাল রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

ব্রি-৭৯

ব্রি-৭৯ আমন মৌসুমের জাত। বন্যার পানিতে এটি ২১ দিন পর্যন্ত পানির নিচে টিকে থাকতে পারে। জাতটি বন্যাসহিষ্ণু হলেও কোন কারণে বন্য না হলেও এর ফলন কম হবে না। যদি বন্যা না হয় তাহলে এর জীবনকাল ১৩৫ দিন। আর বন্যা হলে জীবনকাল কিছুদিন বাড়বে। চালের আকার আকৃতি ব্রি-৪৯ এর মতোই। তবে এর চেয়ে একটু মোটা লম্বা; যা তেমন নজরে আসে না। বন্যা হলে এর গড় ফলন হবে ৫ টন পর্যন্ত, আর বন্য না হলে ফলন হবে সাড়ে ৫ থেকে ৭ টন পর্যন্ত। ব্রি-৪৯ এর চেয়ে বন্যা সহনশীল ও মেগা জাত হওয়ায় উৎপাদন বৃদ্ধিতে জাতটি অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। এক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার তথ্যমতে, সদ্য উদ্ভাবিত ব্রি-৭৯ এর চালের আকার ব্রি-১১ এর মতো নয়। আবার ব্রি-৫১ এর মতোও না। ব্রি-৪৯ এর চেয়ে হালকা সামান্য মোটা। তবে রান্না করলে লম্বা হয়ে যায়। তিনি জানান, জাতীয় কারিগরি কমিটির অনুমোদন লাভ করলেও এটি এখন পর্যন্ত জাতীয় বীজ বোর্ডের অনুমোদন লাভ করেনি। আগামী সভায় চূড়ান্ত অনুমোদন পাবে বলে প্রত্যাশা বিজ্ঞানীদের।

ব্রি-৭৮

ব্রি-৭৮ আমন মৌসুমের জাত। রোপা আমন মৌসুমে একইসঙ্গে উপকূলীয় লবণাক্ততা ও জোয়ার-ভাটাসহিষ্ণু জাত। চারা ও ফুল ফোটা উভয় অবস্থায় ৬-৯ ডিএস/মি মাত্রা পর্যন্ত লবণাক্ততা সহনশীল। ডিগ পাতা খাড়া ও লম্বা, পাতার রং গাঢ় সবুজ। গাছের চারা বেশ লম্বা ও পূর্ণ বয়স্ক গাছের উচ্চতা প্রায় ১২০ সেমি। কুশিগুলো গাছের গোড়ার দিকে ঘনভাবে সন্নিবেশিত ও গাছ মজবুত। ধান ও চালের আকৃতি চিকন এবং লম্বায় মাঝারি। ১ হাজারটি পুষ্ট চালের ওজন ২৪ দশমিক ২ গ্রাম। ভাত ঝরঝরে, রং সাদা। গড় জীবনকাল ১৩৫ দিন। চাষাবাদ পদ্ধতি অন্যান্য উপকূলীয় উফশী আমন ধানের মতোই। রোগ-বালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ অন্যান্য জাতের চেয়ে কম। ৬ থেকে ৮ ডিএস/মি মাত্রার লবণাক্ততায় হেক্টর প্রতি ফলন ৪ দশমিক ৫ থেকে ৪ দশমিক ৮ টন এবং ৪ থেকে ৫ ডিএস/মি মাত্রার কম লবণাক্ততায় ফলন ৫ থেকে সাড়ে ৫ টন।

ব্রি হাইব্রিড-৫

ব্রি হাইব্রিড ৫ বোরো মৌসুমের জাত। দেশীয়ভাবে উদ্ভাবিত বিধায় জাতটির রোগ প্রতিরোধ ও বৈরী পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা বেশি। গাছের উচ্চতা ১০৫-১১০ সেমি। কা- শক্ত বিধায় ঢলে পড়ার সম্ভাবনা নেই। গাছের গোঢ়া খয়েরী রং এর এবং দানায় কাঁচা অবস্থায় লাল বর্ণের টিপ বিদ্যমান। স্বাভাবিক অবস্থায় গাছ প্রতি গুচ্ছির সংখ্যা ১২ থেকে ১৫টি। চালে শর্করার পরিমাণ ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ। চালে প্রোটিন ৯ শতাংশ, ভাত ঝরঝরে। আমন মৌসুমে বীজ উৎপাদনে হেক্টর প্রতি ফলন ১ দশমিক ৫ থেকে ২ টন, এবং বোরো মৌসুমে ২ দশমিক ৫ থেকে ২ দশমিক ৮ টন। গড় জীবনকাল ১৪৪ দিন। হেক্টরপ্রতি ফলন সাড়ে ৮ থেকে ৯ টন।