শিক্ষা: দূর চরগ্রামে আলোকবর্তিকা

নুরুল আলম মাসুদ প্রধান নির্বাহী, পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (প্রান)

চরগ্রামের একটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা কল্পনা করুন। আপনার কল্পনায় গ্রামের কোণে রঙহীন, ভাঙাচোরা, অপরিচ্ছন্ন, ময়লা পোশাকের গুটিকতক ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি নিয়ে এমন কোনো আধাপাকা বা পাকা ঘরের দৃশ্য ভেসে উঠবে। কিন্তু সেটি আসলেই আপনার কল্পনা। সেই দৃশ্য বদলে গেছে। অতীতের সঙ্গে তৈরি করেছে বিশাল ফারাক। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে আরও দক্ষিণে সামনে এলে ধর্মপুর ইউনিয়নের হাজীরহাট বাজার। সেখান থেকে তিনশ’ গজ ভেতরে সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে ছোট্ট একটা সবুজ মাঠ। তিনপাশে তিনটি ঝকঝকে দালান; এর মধ্যে একটি দোতলা ও দুটি একতলা ভবন। ভবনগুলোর সামনে ফুটে রয়েছে নানা রকম ফুল আর সবুজ গাছপালা। বিদ্যালয়টির নাম চরসল্যা ধর্মপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

স্থানীয় শিক্ষানুরাগী হাজি মোহাম্মদ ইব্রাহিমের নেতৃত্বে ১৯৭৪ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয়ের জন্য প্রায় ৫০ শতাংশ ভূমি থাকলেও বর্তমানে ১৯ শতাংশ ভূমি বেদখলে। বর্তমানে বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৫শ’। সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত পরিচালিত পাঠদানের জন্য রয়েছে সাতজন নারী ও তিনজন পুরুষ শিক্ষক মিলে মোট দশজনের সুদক্ষ শিক্ষক দল।

অজপাড়ার এই প্রতিষ্ঠানের স্কুল ড্রেস ও নেমকার্ড রয়েছে সব শিক্ষার্থীর। ছাত্রছাত্রীদের গলায় নেমকার্ড থাকার ফলে তাদেরকে সহজে নাম ধরে ডাকা যায় এবং তা শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করে। তাদের সুপেয় পানির জন্য বসানো হয়েছে গভীর নলকূপ। ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে দুটি আলাদা শৌচাগার। পাশাপাশি প্রত্যেক শিক্ষকের গলায়ও ঝুলছে পরিচয়পত্র, যা সচরাচর অন্য কোথাও দেখা যায় না। বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় সফলতা বেড়েছে অনেক। বর্তমানে পাসের হার শতভাগ। এ ছাড়াও প্রতি বছর জিপিত্র ৫সহ মেধাবৃত্তি অর্জন করছে। শুধু শিক্ষার্থীরা নয়; শিক্ষকদেরও রয়েছে নানা সফলতা। ইতিমধ্যে অগ্রগামী বিদ্যালয় হিসেবে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ৫০ জন প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছেন এবং তারা সব বিবেচনায় এ বিদ্যালয়কে একটি অনুসরণীয় বিদ্যালয় বলে আখ্যায়িত করেছেন।

বিদ্যালয়ের শতভাগ মিড-ডে মিলের আওতায় এসেছে। প্রত্যেক শিক্ষার্থী তাদের বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসে। অভিভাবক রুনা আক্তার জানান, তার ছেলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। মাঝে মাঝে সে সকালের নাশতা বাড়িতে না খেয়ে স্কুলে এনে বন্ধুদের সঙ্গে খেতে চায়। স্কুল চলাকালে খাবারের ব্যবস্থা হওয়ার ফলে শিশুরা পাঠে মনোনিবেশ করতে পারে। পাশাপাশি ক্ষুধার কারণে স্কুল পালানো বন্ধ হয়েছে।

বিদ্যালয়ে পাঠদানের ক্ষেত্রেও রয়েছে বৈচিত্র্য। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সারিবদ্ধভাবে বেঞ্চে বসানোর পরিবর্তে এখানে পুরো শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কয়েকটি ছোট দলে ভাগ করে প্রতিটি দলকে আলাদা টেবিলে বসানো হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে পারে। সেই সঙ্গে দুর্বল শিক্ষার্থীদের প্রতি বাড়তি যত্ন নেওয়া যায়। পাঠদানকে আকর্ষণীয় ও স্থায়ী করতে ব্যবহার করা হয় নানা ধরনের শিক্ষা উপকরণ। পাশাপাশি বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিলেও নানা ধরনের শিক্ষা উপকরণ তৈরি করেন।

বিদ্যালয়ে তৈরি করা হয়েছে ছাত্র ব্রিগেড। এর ফলে বিদ্যালয়ের অনিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া, ক্লাস ফাঁকি ও ঝরে পড়া রোধ করা যাচ্ছে। এ ছাড়াও প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে নিয়মিতভাবে মা সমাবেশ, উঠান বৈঠক, হোম ভিজিট করার ফলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মান যেমন উন্নত হয়েছে; পাশাপাশি বিদ্যালয়ে অনুপস্থি্থতি ও ঝরেপড়া রোধ হয়েছে। সেই সঙ্গে অভিভাবকরা মিড-ডে স্কুল মিল কার্যক্রমকে সক্রিয় রাখার পাশাপাশি বিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে অংশীদারিত্ব তৈরি করেছেন। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী শাহিদা আক্তার জানায়, বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রায়ই তাদের বাড়িতে গিয়ে পড়ালেখার খোঁজ নেন এবং মা-বাবার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করেন।

বিদ্যালয়ের নিজস্ব মাল্টিমিডিয়া না থাকলেও প্রধান শিক্ষকের আগ্রহের কারণে পাশের উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাল্টিমিডিয়া এনে মাঝে মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন বিষয়ে আলোকচিত্র, ইন্টার-অ্যাকটিভ ভিডিও ও পাওয়ার পয়েন্টে উপস্থাপন দেখানো হয়। এটি শিক্ষার্থীরা যেমন উপভোগ করে; পাশাপাশি তাদেরকে ডিজিটাল শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তুলছে।

বিদ্যালয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিকক্ষ। শ্রেণিকক্ষের সামনে ঝুলছে লাল-সাদা পর্দা, মাঝখানে বিশাল ফুলের ঝাড়। বাইরে থেকে কক্ষের দিকে তাকালে যে কারও ভেতরে উঁকি দিতে ইচ্ছা হবে। শ্রেণিকক্ষের ভেতরে মেঝেতে রয়েছে লাল রঙের কার্পেট। দেয়ালের চারপাশ পতাকা, বর্ণমালা, ফল-পাখি-প্রকৃতি-সংখ্যা-ফুলের ছবি দিয়ে সাজানো। সেই সঙ্গে দেয়ালে দুই স্তরে তাক বানিয়ে সাজানো রয়েছে নানা রকম পুতুল, বর্ণমালা, অঙ্ক শেখার উপকরণ, শিশু খেলনা ইত্যাদি।

স্থানীয় হাজীরহাট বাজারের পাশে অবস্থিত বিদ্যালয়টির কোনো সীমানা প্রাচীর নেই, যা খুবই জরুরি। তবুও উন্মুক্ত বিদ্যালয়টির করিডোর, বারান্দা, সিঁড়ি সাজানো রয়েছে নানা রকম ফুলের টব দিয়ে। প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ সাজানো হয়েছে শিক্ষার্থীদের আঁকা ছবি, পাঠ-সংশ্লিষ্ট উপকরণ, রঙিন কাগজে তৈরি ফুল-ফলাদির ছবি দিয়ে। রয়েছে বর্জ্য ফেলার ঝুড়ি। শ্রেণিকক্ষের এ আয়োজন শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাড়তি আকর্ষণ তৈরি করে। এতে তারা বেশি সময় ধরে শ্রেণিকক্ষে অবস্থান করে। পাশাপাশি প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে বৈদ্যুতিক পাখা ও সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বিদ্যালয়ের চেহারা পাল্টে দিতে পেছনে রয়েছে দু’জন মানুষের অবদান। একজন বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমানে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি হাজি মোহাম্মদ ইব্রাহিম, অন্যজন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খাতুন। মূলত রাবেয়া খাতুন ২০১৫ সালে এই বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই সবকিছু বদলে যেতে শুরু করে।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরিতে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে খুদে ডাক্তার টিম। শিক্ষার্থীদের ওজন, উচ্চতা, তাপমাত্রা, রক্তচাপ পরিমাপসহ টিমটি প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থাকে। খুদে ডাক্তারদের দেওয়া হয়েছে ইউনিফর্মসহ প্রাথমিক চিকিৎসা সামগ্রী। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য দাউদ উদ্দিন বলেন, বিদ্যালয়ের আজকের এ অবস্থায় আসার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান বর্তমান প্রধান শিক্ষিকার, সেই সঙ্গে অন্যান্য শিক্ষকের। এ ছাড়া স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, প্রশাসনের কর্মকর্তারাও বিদ্যালয়ের উন্নয়নে অবদান রাখছেন। বর্তমানে বিদ্যালয়ের একটি প্রাচীর তৈরি করা খুবই জরুরি।

বিদ্যালয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়লে অন্য গ্রামের অভিভাবকরাও এ বিদ্যালয়ে তাদের সন্তানদের ভর্তি করাচ্ছেন। সেখানে পড়ালেখা ছাড়াও খেলাধুলা, পরিচ্ছন্নতা, ভদ্রতা, শিষ্টাচার, সৌজন্য, উপকরণ তৈরি ইত্যাদি বিষয়ে শিখতে পারে। পড়ালেখার পাশাপাশি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভালো করছে খেলাধুলা ও স্কাউটিংয়ে। গত দুই বছর

শিক্ষার্থীরা জেলা পর্যায়ে শাপলা কাব অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। এ ছাড়াও উপজেলা পর্যায়ে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তাদের মেধার পরিচয় দিচ্ছে।