চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈসাবি

লেখক: এবিএম আহসান উল্লাহ, বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সহ-অবস্থানে বসবাস করে। ধর্ম যার যার, উত্সব সবার। তাই বিভিন্ন ধর্মীয় ও সমাজবদ্ধ আচার অনুষ্ঠান একই সঙ্গে পালন করে। চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈসাবি এমনই একটি অনুষ্ঠান। একই দিনে বাঙালি পালন করে চৈত্রসংক্রান্তি এবং অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠী পালন করে বৈসাবি অনুষ্ঠান। চৈত্রসংক্রান্তি মানে পুরনো বছরের বিদায় এবং বৈসাবি মানে পুরনো বছরের বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ দুই-ই।

চৈত্রসংক্রান্তি: বঙ্গাব্দ বা বাংলা বছরের সমাপনী মাস চৈত্র। চৈত্রের শেষ দিনটিকে চৈত্রসংক্রান্তি বলা হয়। বাংলাদেশের লোকাচার অনুযায়ী এদিন বর্ষবিদায় উত্সব পালন করা হয়। চৈত্রসংক্রান্তির দিনে সূর্যাস্তের মধ্য দিয়ে কালের গর্ভে চিরতরে হারিয়ে যায় একটি বঙ্গাব্দ। এদিন বাঙালি (আদি বৈদিকরা) বেশকিছু ধর্মীয় ও লোকাচারমূলক অনুষ্ঠান পালন করে। যেমন— গাজন, নীল পূজা বা চড়ক পূজা, চৈত্রসংক্রান্তির মেলা, হালখাতার শেষ প্রস্তুতি ইত্যাদি।

চৈত্রসংক্রান্তির অন্যতম আকর্ষণ লোক উত্সব গাজন। ‘গাঁ’ মানে গ্রাম, ‘জন’ মানে জনগণ। তাই এটি গ্রামের জনগণের উত্সব বা লোক উত্সবরূপে খ্যাত। চৈত্রসংক্রান্তি থেকে শুরু করে আষাঢ়ি পূর্ণিমা পর্যন্ত সংক্রান্তি কিংবা পূর্ণিমা তিথিতে এ উত্সব উদযাপিত হয়। গাজন উত্সবের পেছনে সুদূর অতীতের কৃষকসমাজের একটি সনাতনী বিশ্বাস কাজ করেছিল। চৈত্র থেকে বর্ষার শুরু পর্যন্ত সূর্যের প্রচণ্ড তেজ বা তাপ থাকে। সূর্যের তেজ প্রশমন ও বৃষ্টি লাভের আশায় বাংলাদেশের আদিকালের কৃষিজীবী সমাজ সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর বিয়ে দেয়ার জন্য এ অনুষ্ঠান উদ্ভাবন করেছিল। তখন তারা পৃথিবীকে সূর্যের পত্নী বলে কল্পনা করত। এ উত্সবে আগত লোকজন সূর্যের বরযাত্রী হিসেবে অংশ নিত এবং নাচ-গান ও প্রচণ্ড হই-হল্লা করত।

চৈত্রসংক্রান্তির দিনে আদি বৈদিক ধর্মাবলম্বীরা স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পুণ্যজনক বলে মনে করে। চৈত্রসংক্রান্তির প্রধান উত্সব চড়ক। চড়ক গাজন উত্সবের একটি প্রধান অঙ্গ। এ উপলক্ষে মেলা বসে। চৈত্রসংক্রান্তির মেলায় বাঁশ, বেত, প্লাস্টিক, মাটি ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র ও খেলনা, বিভিন্ন রকমের ফল ও মিষ্টি বেচাকেনা হয়। বায়োস্কোপ, সার্কাস, পুতুলনাচ, ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যাদি চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা থাকে। অঞ্চলভেদে এ মেলা তিন থেকে চারদিন চলে।

বৈসাবি: বাঙালি যেদিন চৈত্রসংক্রান্তি পালন করে, সেদিন অন্যান্য নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় পালন করে তাদের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান— বৈসাবি । পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান প্রধান জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা গোষ্ঠীর লোকজন সাধারণত পুরনো বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে যথাক্রমে— বিঝু,সাংগ্রাই, বৈসুক, বিষু উত্সব পালন করে। ত্রিপুরাদের বৈসুক শব্দ থেকে ‘বি’, মারমাদের সাংগ্রাই থেকে ‘সা’ এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের বিঝু ও বিষু শব্দদ্বয় থেকে ‘বি’ আদ্যাক্ষরগুলোর সমন্বয়ে ‘বৈসাবি’ উত্সবের নামকরণ করা হয়েছে।

বৈসুক: ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উত্সব বৈসুক। বাংলা বছরের শেষ তিনদিন পার্বত্যবাসী খুবই আনন্দের সঙ্গে এ উত্সব পালন করে। সব ধর্মের লোক এ উত্সবে অংশগ্রহণ করে। সামর্থ্যানুযায়ী ঘরের ছেলেমেয়েদের নতুন পোশাক দেয়া হয়, খাবার হিসেবে বিভিন্ন রকমের পিঠা ও পাচন তৈরি করা হয়। বৈসুক উত্সবের প্রধান আপ্যায়নের বস্তু হলো পাচন। পাচন সাধারণত বন-জঙ্গলের হরেক রকমের শাকসবজির মিশ্রণ। তারা মনে করে, বছরের শেষ ঋতু পরিবর্তনের সময় বিভিন্ন শাকসবজি দিয়ে রান্না পাচন খেলে পরবর্তী বছরে রোগবালাই থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। বছরের শেষ দিনের আগের দিনকে হারি বৈসুক, শেষ দিনকে বৈসুকমা আর নতুন বছরকে বলে আতাদাকি। হারি বৈসুক দিনে প্রথমে তারা ফুল সংগ্রহ করে বাড়িঘর, মন্দির সাজায়। তারপর তারা গায়ে কুচাই পানি (পবিত্র পানি) ছিটিয়ে স্নান করে আসে, সঙ্গে বয়োজ্যেষ্ঠদের পানি তুলে স্নান করিয়ে আশীর্বাদ নেয়। পরদিন পাড়ার যুবক ছেলেরা একজন ওঝার নেতৃত্বে দলবেঁধে গরয়া নৃত্যের মহড়া দেয়। এই গরয়া দেবতার পূজা দিয়ে আশীর্বাদ বক্ষবন্ধনী কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখে। তাদের বিশ্বাস, কারায়া গরয়া হচ্ছে বনের হিংস্র পশুদের নিয়ন্ত্রণকারী দেবতা। তার আশীর্বাদ গ্রহণ করলে পরবর্তী বছরে জুম চাষ ও বিভিন্ন কাজে বন-জঙ্গলে গেলে হিংস্র পশুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

সাংগ্রাই: পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমা এবং কক্সবাজার ও পটুয়াখালীর রাখাইনদের অন্যতম প্রধান উত্সব সাংগ্রাই। মারমা বর্ষের শেষ মাস তেংখুং। নববর্ষের প্রথম মাস কোসুং। নববর্ষের পয়লা মাসের প্রথমে এবং বিদায়ী মাসের শেষ দিনে এ উত্সব পালন করা হয়। ত্রিপুরাদের মতো তারাও নতুন জামাকাপড় কেনাকাটা করে এবং বিভিন্ন ধরনের পিঠা, বিনিভাত, পায়েস রেঁধে আত্মীয় বাড়িতে পাঠায়। সাংগ্রাইয়ের মূল আকর্ষণ তরুণ-তরুণীদের জলোত্সব। জলোত্সবের জন্য আগে থেকে প্যান্ডেল তৈরি করে জল মজুদ রাখা হয়। মজুদ রাখা জলের দুদিকে অবস্থান নেয় তরুণ-তরুণীরা। চারদিকে সংগীতের মূর্ছনা চলতে থাকে। তরুণরা জলভর্তি পাত্র নিয়ে এসে একজন তরুণীদের গায়ে ছিটিয়ে দেয়। এর প্রতি উত্তরে তরুণীও তরুণটির গায়ে জল ছিটিয়ে দেয়। এভাবেই চলতে থাকে জলোত্সব। মারমা সম্প্রদায়ের ধারণা, পুরনো বছরের দুঃখ-গ্লানি, ব্যর্থতা সবকিছু ধুয়ে-মুছে যায় এ জল ছিটানোর মধ্য দিয়ে। এভাবেই তারা শেষ করে সাংগ্রাই উত্সব।

বিঝু: চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উত্সব ‘বিঝু’ বা ‘বিষু’। তারা তিন দিনব্যাপী এ উত্সব পালন করে। বাংলা বর্ষের শেষ দিনকে ‘মূলবিঝু’, তার আগের দিনকে ‘ফুলবিঝু’ এবং নববর্ষের প্রথম দিনকে নুয়াবঝর বা গোর্জ্যাপোর্জ্যা দিন বলে। ফুলবিঝুর দিনে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীরা নদীতে গিয়ে কলাপাতায় ফুল ভাসিয়ে দেয়। অনেকে ফুল দিয়ে ঘর সাজায়, নাধেং (ঘিলা, বিবিধ খেলা), নাধেংখারা (লাটিমজাতীয় খেলা) গুদু (হাডুডু) ইত্যাদি খেলার আয়োজন করে। অনেকে আবার চারণ কবি দিয়ে পালাগান পরিবেশন করে।

মুলবিঝু দিনেই চাকমাদের প্রকৃত বিঝু। এদিনে অতিথিদের জন্য দরজা উন্মুক্ত থাকে। কলাপিঠা, সান্যাপিঠা, বিনিপিঠা, বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি ও পানীয় দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়। এ সময় অনেক সদ্য বিবাহিত দম্পতি প্রথমবারের মতো শ্বশুরবাড়িতে (বিষুত ভাঙ্গা) বেড়াতে যায়। মূলবিঝুর দিনে সব বাড়িতে টক, মিষ্টি, পাচন রান্না করা হয়। তাদের বিশ্বাস, বছরের শেষের দিন তিতা, মিঠা খেয়ে বছর বিদায় দেয়া ভালো। এতে বিগত বছরের দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা দূর হয়ে যাবে। নুয়াবঝর বা গোর্জ্যপোর্জ্যা (বছরের প্রথম দিন) দিন প্রার্থনালয়ে গিয়ে আশীর্বাদ গ্রহণ এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের নিমন্ত্রণ ও বয়োজ্যেষ্ঠদের আপ্যায়নের মধ্য দিয়ে তারা নববর্ষ উদযাপন করে।

চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈসাবি উত্সব বাংলাদেশের বাঙালি কিংবা অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠী যে-ই হোক না কেন, সবার কাছে একটি হূদয়স্পর্শী আয়োজন। এগুলো বাংলাদেশের চিরায়ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লোক উত্সব। এ রকম লোকজ উত্সবমূলক অনুষ্ঠান নিয়মিত আয়োজন ও পরিপালনে সরকারি ও বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা থাকা উচিত নয় কি?