বাংলাদেশ নতুন ‘এশিয়ান টাইগার’

ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের প্রতিবেদন

গত দশকে এশিয়ায় দ্রুত অগ্রসরমান অর্থনীতিগুলোর অন্যতম হলো বাংলাদেশ। কম দামের শিল্পপণ্য রপ্তানির মধ্য দিয়ে গত দশকজুড়ে গড়ে ৬ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ, যেমনটি হয়েছিল হংকং, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের শিল্পায়নের সময়। তখন থেকেই এশিয়ান টাইগার বা এশিয়ার বাঘ বলতে এই চারটি দেশকে চেনে বিশ্ববাসী। ‘বাংলাদেশ : দ্য নেক্সট এশিয়ান টাইগার?’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে যুক্তরাজ্যভিত্তিক খ্যাতনামা গবেষণা সংস্থা ‘ক্যাপিটাল ইকোনমিকস’ বলেছে, বাংলাদেশও হতে পারে এশিয়ার নতুন টাইগার।

ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য নিয়ে তৈরি করা এক সংবাদে প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডার বলেছে, মানুষ যখন ‘এশিয়ান টাইগার’ নিয়ে আলোচনা করে, তখন তারা স্বাভাবিকভাবেই হংকং, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানকেই বোঝায়। গত শতকের ষাটের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এই চারটি দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটে। কিন্তু এখন আরো একটি দেশ রয়েছে, যার নাম মনে আসা উচিত : বাংলাদেশ। ’

তবে এশিয়ার টাইগারখ্যাত চার দেশের কাতারে পৌঁছাতে হলে বাংলাদেশকে পাড়ি দিতে হবে আরো অনেক পথ। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শুধু তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল না থেকে ঝুলিতে আরো নতুন নতুন পণ্য যোগ করতে হবে। অবকাঠামোর উন্নয়ন নিশ্চিত করে ব্যবসার পরিবেশ সহজ করতে হবে। গত ৩ এপ্রিল সংস্থাটির প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে এমনটিই বলা হয়েছে। ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটে পাঁচ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সিনিয়র অর্থনীতিবিদ গ্যারেথ লেদার ২০১১ সাল থেকে ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের হয়ে ‘ইমার্জিং এশিয়া টিম’-এ কাজ করছেন। গোল্ডম্যান স্যাক্সে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিবিদ ক্রিস্টাল তানকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন তিনি।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আনতে সরকার বেশ কিছু সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে—উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসবের সুফল পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি। জুলাই মাসে ঢাকা আক্রমণে অনেক বিদেশি নিহত হওয়ার পর সম্প্রতি সিলেটে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও ইসলামপন্থী জঙ্গিদের সংঘর্ষ বাংলাদেশের ধর্মীয় সহিংসতা ও রাজনৈতিক বিভক্তির চিত্র বহন করে।

‘২০১৪-২০১৫ সালে হওয়া সংঘর্ষে ডজনখানেক নিহত হওয়ার সময় থেকে যদিও নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে, তবুও সংশয় রয়ে গেছে। জাতীয় সংসদের নিয়ন্ত্রণ আওয়ামী লীগের হাতে। সংসদের আসন সংখ্যার ৮০ শতাংশই আওয়ামী লীগদলীয়। ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে। ২০১৯ সালের আগে সংসদীয় নির্বাচন হচ্ছে না। এ সময়ের মধ্যে ভ্যাট আইন কার্যকর, অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিনিয়োগ পরিবেশ সহজ করার মাধ্যমে মোট দেশজ উত্পাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে নিয়ে যাওয়া সরকারের জন্য বড় সুযোগ’—যোগ করেছে ক্যাপিটাল ইকোনমিকস।

সংস্থাটি বলেছে, গেল বছরগুলোতে বাংলাদেশ এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে অন্যতম সেরা পারফরমার। ২০১১ সাল থেকে চীন তার সস্তা পণ্যের যে পরিমাণ বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নে হারিয়েছে, তার দুই-তৃতীয়াংশই দখল করেছে বাংলাদেশ। তবে সরকার ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা থেকে কিছুটা পিছিয়ে আছে। গত ৫০ বছরে এশিয়ার যেসব দেশ দ্রুত উন্নতি করেছে, তাদের সমকক্ষ হতে হলে বাংলাদেশকে তৈরি পোশাকের বাইরে অধিক মূল্য সংযোজনকারী পণ্যের দিকে মনোযোগী হতে হবে। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৯০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক ও ফুটওয়্যার থেকে। আর দেশটির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচিত ভিয়েতনাম এ দুটি খাত থেকে তার মোট রপ্তানির মাত্র ২২ শতাংশ অর্জন করে।

২০২০ সাল নাগাদ ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনে সরকারি লক্ষ্যমাত্রাকে ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী’ উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৫০ বছরে এশিয়ার অর্থনৈতিক অগ্রগতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে মনে হয়, এটি সম্ভব। বাংলাদেশ এখন যে অবস্থায় রয়েছে, এশিয়ার অর্থনৈতিক সফলতা অর্জনকারী দেশগুলোর এই অবস্থা থেকে অন্তত এক দশক ধরে ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের নজির রয়েছে।

‘কম মজুরি ও দ্রুত বর্ধমান শ্রমশক্তির কারণে চীনের সস্তা পণ্য উত্পাদনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ টানার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। তবে বাংলাদেশ যদি এশিয়ার সফল দেশগুলোর সমকাতারে পৌঁছাতে চায়, তাহলে তাকে তৈরি পোশাকের বাইরে অন্যান্য খাতের বিকাশে মনোযোগী হতে হবে। এসব খাতের মধ্যে হতে পারে ইলেকট্রনিক ও অন্যান্য কনজ্যুমার পণ্য, যা অধিক মূল্য সংযোজন করে’—পরামর্শ সংস্থাটির।

ক্যাপিটাল ইকোনমিকস মনে করে, এশিয়ান টাইগার হতে হলে বাংলাদেশকে অবকাঠামো উন্নয়ন ও স্বচ্ছ বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা গুণগতমানের অবকাঠামোর অভাব। অপর্যাপ্ত বন্দর ও সরু রাস্তার কারণে পণ্য পরিবহনে সময় ও খরচ অনেক বেশি হচ্ছে। আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো দেশটির দুর্বল বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতির নিম্নমানের দিক থেকে পাকিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশের ২০ শতাংশেরও বেশি মানুষ এখনো বিদ্যুৎ সংযোগের বাইরে। ভরসাযোগ্য বিদ্যুতের অভাবে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ব্যয়বহুল জেনারেটর ব্যবহার করছে।   বিশ্বব্যাংকের হিসাবে প্রতিটি দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে জিডিপির ৫.৫ শতাংশ বিনিয়োগ করা উচিত, বাংলাদেশের বিনিয়োগের পরিমাণ এর চেয়েও কম।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তবে উত্সাহব্যঞ্জক দিক হলো, নীতিনির্ধারকরা এরই মধ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন ও ব্যবসার প্রক্রিয়াগুলো সহজীকরণে উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশের রাজস্ব আয়ের পরিমাণ জিডিপির ১০ শতাংশের সামান্য ওপরে, যা এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। রাজস্ব আদায় বাড়াতে সরকার নতুন ভ্যাট আইন কার্যকরের পরিকল্পনা করছে, যদিও তা কয়েকবার স্থগিত রাখা হয়েছে। নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলে অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থের জোগান বাড়ানো সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চীন থেকেও কিছু সহায়তা পাবে। দেশটি তাদের ‘একদেশ এক বেল্ট’ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশে বিপুল অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে। এক্সপ্রেসওয়ে, রেল, সড়ক, সেতু ও বিদ্যুেকন্দ্রে চীন বাংলাদেশে ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে।