পাঁচ জয়িতার ফল্যগাথা

অর্থনৈতিক সংকট ও পারিবারিক জীবনের শত প্রতিকূলতাকে অদম্য প্রচেষ্টায় পরাস্ত করে সফলতা অর্জন করেছেন এমন পাঁচ জয়িতা জানিয়েছেন তাদের জীবনের সাফল্যগাথা। কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার ওই পাঁচ জয়িতা হলেন- জামিলা আক্তার, জুলি আক্তার, কাজী কামরুন নাহার, মারুফা আক্তার ও পারভীন আক্তার। জীবনের ফেলে আসা বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে তারা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন, চোখ ভিজে যায় তাদের। ফেলে আসা দিনগুলো যেন তাদের কাছে শুধুই কষ্টের অতীত। আজ তারা নিজ নিজ অবস্থানে বেশ সফল ও স্বাবলম্বী। চাকরি ক্ষেত্র ছাড়াও সফল জননী এবং অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জন করে জয়িতারা সমাজের উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন, অন্যদেরও অভাব আর দুঃখ-কষ্টকে জয় করে চলার পথ দেখাচ্ছেন।

সাফল্য অর্জনকারী নারী জামিলা আক্তার বলেন, ‘বিয়ের পর খেয়ে না খেয়ে কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সংসার জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে। শিক্ষকতা করে জীবিকা নির্বাহ করেছি। দুর্ঘটনায় স্বামী মারা যাওয়ার পর বাবার বাড়িতে চলে আসাটা মা-বাবা ও ভাইয়েরা স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। তাই বাধ্য হয়ে পুনরায় স্বামীর বাড়িতে ফিরে আসি। আমার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে পড়াশুনা করে। বর্তমানে আমি চৌয়ারা নূরানী মহিলা মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করছি। অতীতের সকল দূরবস্থা কাটিয়ে বর্তমানে সচ্ছলতা অর্জন করেছি।’

জয়িতা জুলি আক্তার বলেন, ‘বিয়ের পর স্বামী কর্তৃক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হই। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে ১ বছরের শিশু সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে আসি। কিন্তু এখানে আমার বেশিদিন ঠাঁই হয়নি। হতাশ না হয়ে আমি এলাকার শিশুদের পড়াতে থাকি। পরে ইউনিয়ন পরিষদে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করি। দারিদ্র্য ও প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে একখণ্ড জমির মালিক হই। ২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনে সংরক্ষিত আসনে সদস্য নির্বাচিত হই এবং নির্যাতনের সকল দুঃখ-যন্ত্রনা মুছে আমি নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করি।’

মারুফা আক্তার বলেন, ‘বিয়ের প্রায় ৫ বছর পর স্বামী মারা যায়। তখন আমি ২ সন্তানের মা। অসহায় হয়ে বাবার বাড়িতে চলে যাই। কিন্তু বাবা-মা ও ভাইরা তা মেনে নেয়নি। অভাবের তাড়নায় হতাশ হয়ে পড়ি। একপর্যায়ে আমি এলাকার শিশুদের আরবি পড়িয়ে জমাকৃত টাকা দিয়ে বিদেশে (ওমান) চলে যাই। চাকরি করে সন্তানদের ভরন-পোষণ ও পড়াশুনা করাই। মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ও ছেলে তৃতীয় শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। এলাকায় আমার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসনে সদস্য নির্বাচিত হই। সকল দুঃখ মুছে আমি নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করি।’

পারভীন আক্তার বলেন, ‘আমার যখন বিয়ে হয় তখন স্বামীর আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তাই ঢাকায় একটি গার্মেন্টসে ও পরে ইপিজেডে চাকরি করে কোনো মতে সংসার চালাই। ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ বহন করি। বর্তমানে আমি ধান চাষ করি এবং থ্রি-পিছ, ব্লক-বুটিক প্রিন্ট ও ফার্নিচার মালামাল বিক্রি করে খুব ভাল আছি। এখন আমি স্বাবলম্বী একজন নারী।’

জয়িতা কাজী কামরুন নাহার বলেন, ‘আমি বেশি পড়াশুনা করিনি। তবুও পরিস্থিতির কারণে আমাকেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। পারিবারিক-আর্থিক চরম প্রতিকূলতার মাঝে জমির সামান্য আয় দিয়ে ৭ সন্তানের পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছি। আমার স্বপ্ন— সন্তানদের সুশিক্ষিত, আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। প্রথম সন্তান মেয়ে কুমিল্লা প্যারামেডিক্যালে, দ্বিতীয় মেয়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বাংলায় মাস্টার্স, তৃতীয় মেয়ে কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজে সমাজকর্মে মাস্টার্স, চতুর্থ মেয়ে ভিক্টোরিয়া কলেজে বিএ, পঞ্চম মেয়ে কুমিল্লা সরকারি কলেজে ইংরেজিতে অনার্স, ষষ্ঠ সন্তান ছেলে নোয়াখালী কৃষি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং-এ, ৭ম সন্তান ছেলে কুমিল্লা রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সততাপূর্ণ ইচ্ছা বা আগ্রহ থাকলে যে কোনো প্রতিকূলতাকে জয় করে এগিয়ে চলা সম্ভব বলে মনে করেন এ জয়িতা।’

জানতে চাইলে সদর দক্ষিণ উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা তানজুমা পারভীন লুনা বলেন, ‘সমাজের প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে লড়াই করে যেসব নারী সফল কিংবা স্বাবলম্বী হয়েছেন তাঁদের উত্সাহ প্রদানের জন্য প্রতিবছর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে জয়িতা অন্বেষণ করা হয়। সমাজের অবহেলিত নারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে আগামীর পথচলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে জয়িতা অন্বেষণ। জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে গত ১৪ মার্চ পাঁচ জয়িতার প্রত্যেককে একটি সম্মাননা সনদ, ক্রেস্ট প্রদানসহ তাঁদের উত্তরীয় পরিয়ে দেয়া হয়।’